পাহাড়ের বুকে দৌড়বিদদের স্বপ্ন—বার্তা কি?

আলীকদমে অ্যাডভেঞ্চারের দোলা: ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স আল্ট্রা—এডিশন–৩’ ম্যারাথনে ৪৫০ দৌড়বিদের অংশগ্রহণ।
অসীম রায় (অশ্বিনী), বান্দরবান: পার্বত্য জেলা বান্দরবানের আলীকদমে শুক্রবার (৫ ডিসেম্বর) ভোরে অনুষ্ঠিত হলো দেশের অন্যতম কঠিন পাহাড়ি দৌড় প্রতিযোগিতা ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স আল্ট্রা: এডিশন–৩’।
পাহাড়ি উঁচু-নিচু পথ ও জঙ্গলের বিশেষ চ্যালেঞ্জিং রুটে ৫২ কিলোমিটার ও ২৫ কিলোমিটার দুই ক্যাটাগরিতে দৌড়ালেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা প্রায় ৪৫০ জন দৌড়বিদ।
সকালবেলার কুয়াশা, পাহাড়ি বাতাস ও খাড়া রুটকে সঙ্গী করে দৌড়ের সূচনা হয় আলীকদম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে। সেখান থেকে দৌড়বিদরা কুরুকপাতা পর্যন্ত গিয়ে আবার একই স্থানে ফিরে আসেন।
এ বছরের প্রতিপাদ্য ছিল ‘For Wildlife, For Earth’—বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও পরিবেশ রক্ষার বার্তা পৌঁছে দেওয়া। পাহাড়ি বনের বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীকুল, বিশেষ করে রাজধনেশ পাখিকে প্রতীকীভাবে তুলে ধরা হয় পোস্টার ও লোগোর মাধ্যমে। আয়োজকেরা জানান, পাহাড়ি জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধিই তাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য।
৫২ কিলোমিটার আল্ট্রা ম্যারাথনের পুরুষ বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হন মো. সাজ্জাদ হোসাইন, নারী বিভাগে সেরা হন সিফাত ফাহমিদা ইতি, আর জ্যেষ্ঠ বিভাগে প্রথম হন মো. আমিনুর রহমান। অন্যদিকে ২৫ কিলোমিটার দৌড়ে পুরুষ বিভাগে প্রথম আবদুল্লাহ আল নোমান, নারী বিভাগে সৈয়দা ফাতেমি ওয়ারদা, এবং জ্যেষ্ঠ বিভাগে মো. আবদূর রব শীর্ষস্থান অর্জন করেন। দৌড় শেষে প্রতিযোগীদের মুখে ছিল ক্লান্তি জয়ের আনন্দ আর তৃপ্তির ছাপ।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে আলীকদম সেনানিবাসের জোন কমান্ডার লে. কর্নেল মো. আশিকুর রহমান বলেন, পাহাড়ি এলাকায় এত বড় সংখ্যক দৌড়বিদের অংশগ্রহণ সত্যিই বিরল। তাঁর ভাষায়, দীর্ঘ দূরত্বের দৌড় এখন স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের “নীরব বিপ্লব”। রেস ডিরেক্টর ফরহান জামান জানান, প্রতি বছর নতুন ও চ্যালেঞ্জিং পাহাড়ি রুটে দৌড় আয়োজনের চেষ্টা করা হয়। পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ আয়োজন আরও বড় আকারে নিয়মিতভাবে করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এর আগে ২০২৩ সালে এই ইভেন্ট হয়েছিল আলীকদম–ডিম পাহাড়–থানচি সড়কে এবং গত বছর অনুষ্ঠিত হয় বান্দরবান–চিম্বুক সড়কে। ফলে দেশের এন্ডুরেন্স দৌড়বিদদের কাছে এই প্রতিযোগিতা এখন এক বিশেষ অ্যাডভেঞ্চারের নাম। সম্পূর্ণ দাতব্য এ উদ্যোগ থেকে পাওয়া উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যয় করা হবে আলীকদম ও লামা অঞ্চলের আদিবাসী শিশুদের শিক্ষায়, যা পাহাড়ি অঞ্চলের মানবিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ইভেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় ছিল লিবারেল ফ্যাশন অ্যান্ড প্যাকেজিং, ট্রাভেল প্রো ও কিচেন এক্সপার্ট। সার্বিক সহযোগিতায় ছিল আলীকদম সেনানিবাস, বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড, উপজেলা প্রশাসন ও আলীকদম থানা। পাহাড়ি অ্যাডভেঞ্চার, পরিবেশ রক্ষার বার্তা ও দৌড়বিদদের উৎসাহ—সব মিলিয়ে এ বছরের আয়োজনটি আলীকদমে ক্রীড়া, প্রকৃতি ও মানবিকতার এক অনন্য উৎসবে পরিণত হয়েছে।
পাহাড়ের বুকে দৌড়বিদদের স্বপ্ন—আলীকদমের আল্ট্রা ম্যারাথন কী বদলে দিচ্ছে
পাহাড় কেবল দৃশ্য নয়—এ এক অনুভূতি, এক সাহস। আর সেই সাহসকে বাস্তবে পরিণত করতেই প্রতি বছর বান্দরবানের আলীকদমে জড়ো হন দেশের শত শত দৌড়বিদ। ‘ভার্টিক্যাল ড্রিমার্স আল্ট্রা’ শুধু একটি দৌড় নয়, এটি এখন পাহাড়ি জীবন, পরিবেশ, ও মানবিকতার এক মিলনমেলা।
যে রুটে সাধারণ মানুষের হাঁটাও কঠিন, সেখানে ৫২ কিলোমিটার ছুটে চলা কেবল শক্তি নয়, মানসিক দৃঢ়তারও পরীক্ষা। আশ্চর্যের বিষয়—এই কঠিনতম দৌড়ে অংশ নেন সদ্য তরুণ থেকে সত্তরোর্ধ প্রবীণ দৌড়বিদ। তাদের চোখে–মুখে যে আগুন, তা পাহাড়ের চূড়ায় ওঠা সকালের সূর্যের মতোই তীব্র।
এই আয়োজনের সবচেয়ে মানবিক দিক—উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যয় হয় স্থানীয় বিদ্যালয়ের আদিবাসী শিশুদের শিক্ষায়। ক্রীড়া–অ্যাডভেঞ্চার–মানবিকতা—একসঙ্গে এমন নিখুঁত সমন্বয় বাংলাদেশের খুব কম ইভেন্টেই দেখা যায়।
আরেকটি বড় অর্জন—বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ বার্তা। রাজধনেশের প্রতীক ব্যবহার, ‘For Wildlife, For Earth’ প্রতিপাদ্য, অংশগ্রহণকারীদের সচেতনতা—সব মিলিয়ে পাহাড়ি পরিবেশ রক্ষার এই প্রচেষ্টা সময়ের দাবি।







