ভূমিকম্পে ক্ষতি কমাতে প্রস্তুতি ও সচেতনতায় জোর

টুইট ডেস্ক: আবারও ভূমিকম্পে কাঁপল বাংলাদেশ। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা ১৪ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়। তবে ভূমিকম্পটি তেমন জোরালো ছিল না। এ নিয়ে গত দুই সপ্তাহের মধ্যে দেশে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প অনুভূত হলো, যার বেশিরভাগেরই উৎপত্তিস্থল ঢাকার নিকটবর্তী জেলা নরসিংদীতে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পনের মাত্রা ছিল ৫ দশমিক ৭, যা গত কয়েক দশকের মধ্যে বাংলাদেশে হওয়া সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্প। তিনটি সক্রিয় টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত বাংলাদেশে কয়েকদিনের মধ্যে একের পর এক এমন ভূমিকম্পের ঘটনায় এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় যথাযথ প্রস্তুতি না থাকার পাশাপাশি সামনে এসেছে প্রায় সব শ্রেণির-মানুষের মাঝে সচেতনতার ঘাটতির বিষয়টি। সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় আগে থেকে নানান সচেতনতা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার কথা বললেও এখন স্বীকার করছে, তা যথেষ্ট নয়। এ প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমিকম্পে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি কমাতে পূর্বপ্রস্তুতি, জনসচেতনতা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে হবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের কর্মকর্তা রুবাঈয়্যাৎ কবীর জানান, গতকাল সকালের ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে ৩৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে নরসিংদীর শিবপুরে। এটি ছিল হালকা মাত্রার ভূমিকম্প; রিখটার স্কেলে মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ১। তিনি বলেন, সামনে এমন আরও ভূমিকম্পের ঝুঁকি রয়েছে। ভবিষ্যতে যে কোনো দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য এখন থেকেই সবাইকে সচেতন হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

ইউরোপিয়ান মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টার (ইএমসিএস) বলছে, নরসিংদী থেকে ৩ কিলোমিটার উত্তরে ছিল এ ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল। এর আগে গত ২৭ নভেম্বর বিকেল সোয়া ৪টায় দেশে ভূমিকম্প হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীরই ঘোড়াশাল। সেটি ছিল ৪ মাত্রার। মাঝে গত সোমবার রাতে মিয়ানমারের ফালামে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হয়, যা অনুভূত হয়েছে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম অঞ্চলেও। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ সময় রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে হওয়া ওই ভূমিকম্পের মাত্রা ছিল ৪ দশমিক ৯।

গত ২১ নভেম্বর কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্প হয় বাংলাদেশে। ওই ভূমিকম্পে তিন জেলায় অন্তত ১০ জনের মৃত্যু হয় এবং ছয় শতাধিক মানুষ আহত হন। রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ওই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকা থেকে মাত্র ১৩ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীর মাধবদীতে এবং এর কেন্দ্র ছিল ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। পরদিন সকালে নরসিংদীর পলাশে ৩ দশমিক ৩ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়। তার রেশ না কাটতেই সন্ধ্যায় সেকেন্ডের ব্যবধানে দুটি ভূমিকম্প হয়, যার একটির উৎপত্তিস্থল ছিল ঢাকার বাড্ডা, আরেকটি সেই নরসিংদীতে।

গত ২১ নভেম্বর ভূমিকম্পের সময় ফসলি জমি থেকে আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে আসার পথে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান নরসিংদীর কাজীরচর নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী নাসির উদ্দিন। এ ছাড়া ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কিত হয়ে তাড়াহুড়া করে ভবন থেকে নামতে গিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেকে আহত হয়েছেন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মেহেদি আহমেদ আনসারীর মতে, দেশে কোনো পর্যায়ে পর্যাপ্ত সচেতনতা কার্যক্রম না থাকার কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, ‘সবারই কম বেশি নেগলিজেন্সি আছে। যে যত কিছুই বলুক, কাজের কাজ কিছুই করে নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে একটা বড় ভূমিকম্প হবেই। সেজন্য সবাইকে এখনই সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি নিয়মিত মহড়া প্রয়োজন।

ভূমিকম্প নিয়ে সচেতনতার কথা তুলতেই ঢাকার একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা নাসির আহমেদ বলেন, ‘টুকটাক কিছু করণীয় বিষয় জানা আছে। কিন্তু ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কের কারণে সেসব মাথায় থাকছে না কারও। আমার মনে হয় এটিও একটি জানার ঘাটতি। করণীয় বিষয়েও কারও মধ্যে স্পষ্ট ধারণা নেই। ভূমিকম্পের সময় দেখেছি, সবাই দৌড়ঝাঁপ দিয়ে বাসা থেকে নেমে যায়। ঢাকার মতো শহরে দৌড়ে নিচে গেলেই কি সবাই নিরাপদ? তার ওপর নামতে গিয়ে অনেকে আহত হচ্ছেন।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার কালবেলাকে বলেন, ‘ভারতীয় প্লেটটি ধীরে ধীরে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে বার্মা প্লেটের নিচে, অর্থাৎ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে। আর এ তলিয়ে যাওয়ার কারণে একটা সাবডাকশন জোন তৈরি হয়েছে। এ জোনের ব্যাপ্তি সিলেট থেকে টেকনাফ পর্যন্ত বিস্তৃত। পুরো চট্টগ্রাম অঞ্চল এর মধ্যে পড়েছে। এখানে বিভিন্ন সেগমেন্ট আছে। আমাদের এ সেগমেন্টে ৮ দশমিক ২ থেকে ৯ মাত্রার শক্তি জমা হয়ে আছে। এটা বের হতেই হবে। এখানে প্লেট লকড হয়ে ছিল।

তিনি বলেন, ‘আমাদের এ অঞ্চলে ২৫০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সাবডাকশন জোনের নরসিংদীতে একটি পয়েন্টে সামান্য একটু ফলক উন্মোচিত হয়ে গত ২১ নভেম্বর ভূমিকম্পে কিছুটা শক্তি বের হয়েছে, যেটা শূন্য দশমিক এক শতাংশের কম। এরপর আফটার শক বা যেটাই হোক উত্তর-দক্ষিণে হবে। দেখা গেল পরের সবই উত্তরে হচ্ছে। বৃহস্পতিবার আরেকটু উত্তরে হয়েছে। উত্তর-দক্ষিণ কাছাকাছি একটা প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে সবই ভারতীয় প্লেটের মধ্যে সংগঠিত হচ্ছে এবং সংযোগস্থলের অতি নিকটে।

অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার বলেন, ‘এখনকার ছোট ছোট কম্পন আফটার শক নাকি ফোরশক-তা এ মুহূর্তে বলা কঠিন। সামনে আরও পর্যবেক্ষণের দরকার আছে। সামনে যদি দীর্ঘদিন আর ভূমিকম্প না হয়, তাহলে প্রথম দিনের (২১ নভেম্বর) বড় ভূমিকম্পটি মেইনশক, পরেরগুলো হচ্ছে আফটার শক। এমনও হতে পারে যে, এক মাস দুই মাস পর একটা বড় ভূমিকম্প হয়ে গেল। তখন এগুলো হয়ে যাবে ফোরশক।

বড় ধরনের একটি ভূমিকম্পের বিপদ বাংলাদেশের সামনে অপেক্ষা করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন বলেন, ‘ওই ঝুঁকি বিপজ্জনক মাত্রায় পৌঁছেছে জনগণের সচেতনতা, সরকারের পরিকল্পনা এবং প্রস্তুতির অভাবে। সব কথার শেষ কথা যেটা হচ্ছে, আমাদের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং ভূমিকম্প প্রতিরোধ বা ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। এটার জন্য সামাজিক আন্দোলন করতে হবে। ভূমিকম্পের নিয়মিত মহড়া করতে হবে। এখানে সবারই দায়িত্ব আছে। সাধারণ মানুষ, সরকার, রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন পেশাদার-সবার আসলে এখানে দায়িত্ব রয়েছে, তাদের নিয়ে সামাজিক আন্দোলন তৈরি করে যদি আমরা জনগণকে সচেতন করতে পারি, তাহলে বড় ধরনের ভূমিকম্পেও জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ন্যূনতম পর্যায়ে আনা সম্ভব।

ভূমিকম্প নিয়ে জনমনে আতঙ্কের মধ্যে গত ২৪ নভেম্বর বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। ওই বৈঠকে একটি টাস্কফোর্স গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। সেখানে উপস্থিত এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওখানে ভূমিকম্প নিয়ে বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামত দিয়েছেন। সরকার শুনেছে, আরও সাজেশন চেয়েছে। এটি দ্রুত করার কথা বলা হয়েছে, সে অনুযায়ী সরকারকে আরও সাজেশন দেওয়া হবে। তারপরই কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে।’

সরকারিভাবে অনেক আগে থেকেই সচেতনতা কার্যক্রম চলমান থাকার কথা বলেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিবীক্ষণ ও তথ্য ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগের পরিচালক নিতাই চন্দ্র দে সরকার। তিনি বলেন, ‘আমরা অনেক আগে থেকেই ঢাকা, চট্টগ্রামসহ সিটি এলাকায় স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে অ্যাওয়ারনেস রেইজিং প্রোগ্রাম করেছি। এর করণীয় বিষয়গুলো এবং এর ঝুঁকি কোথায় কী আছে-এগুলো আলোচনা হয়েছে।’

তথ্যচিত্রের মতো বিভিন্ন ‘অ্যাওয়ারনেস রেইজিং ম্যাটেরিয়াল’ থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্প হলে পার্সোনাল লেভেলে করণীয় কী হবে, তা নাটিকার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। লিফলেট আকারেও কিছু মেসেজ দেওয়া হচ্ছে। লিফলেটগুলো আমাদের ওয়েবসাইটেও আছে।’ এর বাইরে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, কর্মশালার মতো কর্মসূচি থাকলেও সেসব যে পর্যাপ্ত না তা মানছেন এই কর্মকর্তাও।

পর পর বেশ কয়েকটি ভূমিকম্প হওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে ভূমিকম্পের সময় করণীয় বিষয়ে একগুচ্ছ নির্দেশনা প্রচার করা হয়েছে। আট দফা নির্দেশনা দিয়ে পাঠানো ওই বার্তায় আতঙ্কিত না হয়ে ভূমিকম্প চলাকালীন ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সবার প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।