পাহাড়ের গণ্ডি পেরিয়ে প্রথমবার ঢাকায় আসছে ম্রো শিশুরা

‘পাওমুম পার্বণ ২০২৫’-এ ম্রো সংস্কৃতির ঝলক নিয়ে রাজধানীতে পা দেবে দুর্গম পাহাড়ি পাড়ার শিশুরা।
নিজস্ব প্রতিনিধি: বান্দরবানের লামা উপজেলার সুদূর চংককপাড়া—একটি এলাকা যেখানে যাওয়ার পথও পাহাড়ি মানুষের সংগ্রামী জীবনের মতোই কঠিন।
লামা সদর থেকে সড়ক পথে কিছু দূর, তারপর খাড়া পাহাড়ি জঙ্গল আর কাঁকর রাস্তা ধরে প্রায় দেড় ঘণ্টার হাঁটা। নেই বিদ্যুৎ, নেই মোবাইল নেটওয়ার্ক, নেই নিরাপদ পানি বা চিকিৎসা সুবিধা। ঠিক এমন একটি বিচ্ছিন্ন পাড়ার শিশুরাই প্রথমবারের মতো ঢাকায় আসছে ‘পাওমুম পার্বণ ২০২৫’-এ অংশ নিতে।
ঢাকার আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে আগামী ১৭ থেকে ২৩ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে এই সপ্তাহব্যাপী আয়োজন। প্রতিপাদ্য ‘From Hills to Hope’—পাহাড় থেকে জন্ম নেওয়া আশার গল্প। এ উৎসবে অংশ নিতে গজালিয়া ইউনিয়নের ‘পাওমুম থারক্লা’ স্কুলের মোট ৬৮ জন শিক্ষার্থী, তাদের অভিভাবক এবং পাড়ার প্রবীণরা ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করবেন।
উৎসবে কী থাকছে?
এই প্রথম ঢাকাবাসী সরাসরি দেখতে পাবে ম্রো শিশুদের হাতে তৈরি কারুকাজ, শিল্পকর্ম, বাঁশের ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী ও নৃত্য-গানের পরিবেশনা। থাকবে প্লুং (বাঁশি), ম্রো থিয়েটার, ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্টল এবং ম্রো নারীদের বয়নশিল্প। প্রবীণরা শুনিয়ে দেবেন ম্রো লোককাহিনী ও জীবনগাথা—যা আজও লিখিত ইতিহাসের বাইরে।
পাওমুম থারক্লা স্কুল: পাহাড়ের এক আশ্রয়স্থল
গজালিয়া ইউনিয়নের চংককপাড়ায় ২০১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় স্কুলটি। ফ্রিল্যান্সার শাহরিয়ার পারভেজ ও স্থানীয় তরুণ উথোয়াইয়ই মারমাসহ কয়েকজন মিলে শুরু করেন এই উদ্যোগ। আশপাশের পাঁচটি পাড়া থেকে এখন এখানে পড়ে ৬৮ শিশু—যার মধ্যে ৩০ জন হোস্টেলে থাকে। পাঁচজন শিক্ষক শিশু শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান করেন।
এ স্কুলের বিশেষত্ব হলো—বাংলার পাশাপাশি ম্রো মাতৃভাষায় শিক্ষা, সংস্কৃতি ও লোককাহিনী শেখানোর নিয়মিত ব্যবস্থা। বছরে হোস্টেল ফি ৯ হাজার টাকা হলেও নগদ না দিতে পারলে চাল, ডাল বা সবজি গ্রহণ করা হয়। দেশ-বিদেশের অনেক শুভানুধ্যায়ী নিয়মিত সহায়তা করে স্কুল চালিয়ে নিতে সাহায্য করছেন।
উদ্যোক্তাদের ভাষ্য
সহ-প্রতিষ্ঠাতা উথোয়াইয়ই মারমা বলেন, “পাহাড়ে শেখার সুযোগ খুবই কম। ম্রো ভাষা ও সংস্কৃতি হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের স্কুল সেই সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। ঢাকায় গিয়ে আমরা আমাদের গল্প শহরের মানুষের সাথে ভাগ করে নিতে চাই।”
প্রতিষ্ঠাতা শাহরিয়ার পারভেজ বলেন, “পাহাড়ে স্কুল চালানো অত্যন্ত কঠিন। শিশুদের পড়ালেখা চালিয়ে নিতে একটি স্থায়ী তহবিল খুব জরুরি। সবাই একটু করে সাহায্য করলে এই স্বপ্ন দীর্ঘস্থায়ী হবে।”
শিশুদের চোখে আনন্দ আর স্বপ্ন
ঢাকায় যাওয়ার খবরে শিশুদের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক। তারা বলে, “ঢাকা দেখব, বিমান দেখব, বড় বড় বাড়ি দেখব, ট্রেনে চড়ব!”
দশ বছর ধরে পাহাড়ের গণ্ডিতে বন্দি থাকা এই শিশুরা এবার প্রথমবারের মতো বেরিয়ে আসছে বাইরের পৃথিবীর সামনে। ‘পাওমুম পার্বণ ২০২৫’ তাই শুধু একটি উৎসব নয়—এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী ম্রোদের সংস্কৃতি, আশা ও ভবিষ্যৎকে জাতির সামনে তুলে ধরার এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
পাহাড় থেকে আশা নিয়ে তারা আসছে—এবার দায়িত্ব ঢাকাবাসীর, তাদের হাত ধরে এগিয়ে নেওয়ার।









