রাঙ্গামাটির দুর্গম কুড়ামারায় সেনাবাহিনীর বিনামূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্প

১২২ পাহাড়ি বাসিন্দা পেলেন চিকিৎসা ও ঔষধ, জোন কমান্ডারের তাৎক্ষণিক উদ্যোগে মানবিক সাড়া।

শ‌হিদুল ইসলাম: পার্বত্য রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার অতি দুর্গম পাহাড়ি এলাকা কুড়ামারা, টং তুলিয়াপাড়া ও আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। নিকটতম হাসপাতাল বা ফার্মেসি নেই, পাকা রাস্তা নেই। অসুস্থ হলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পায়ে হেঁটে বা নৌকায় করে শহরে যেতে হয়।

এমন করুণ চিত্র চোখে পড়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নানিয়ারচর জোন (১৭ ইস্ট বেঙ্গল) তাৎক্ষণিকভাবে একটি বিনামূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্পেইনের আয়োজন করে।

গত সোমবার (২ ডিসেম্বর) সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কুড়ামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে এই মেডিকেল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়।

গত ২৫ নভেম্বর থেকে এলাকায় চলমান বিশেষ অপারেশনের সময় টহলরত সেনা সদস্যরা স্থানীয়দের স্বাস্থ্যগত দুরবস্থা দেখতে পেয়ে জোন কমান্ডার লে. কর্নেল মোঃ মশিউর রহমান, পিএসসি (বিএ-৭৯০০) এর নির্দেশে তাৎক্ষণিক এ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।

কারা চিকিৎসা পেলেন?

মোট রোগী: ১২২ জন
পুরুষ: ৩০ জন
নারী: ৮০ জন
শিশু: ১২ জন

সবাইকে বিনামূল্যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ঔষধ সরবরাহ করা হয়। চিকিৎসা প্রদান করেন নানিয়ারচর জোনের মেডিকেল অফিসার ক্যাপ্টেন আশিকুজ্জামান (বিএ-১০২৬৯৪)। পুরো কর্মসূচি সরেজমিনে তদারকি করেন জোন কমান্ডার নিজে।

স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া

চিকিৎসা নিতে আসা বয়স্ক মহিলা লক্ষ্মী চাকমা (৬৫) বলেন, “আমার পেটের ব্যথা অনেক দিনের। ডাক্তার দেখানোর টাকা-পয়সা নাই, রাস্তাও নাই। আজ সেনা সাহেবরা এসে ফ্রি ঔষধ দিল, মনটা ভরে গেল।”
কুড়ামারা গ্রামের যুবক সুমন তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, “এমন ক্যাম্প যদি মাসে একবারও হয়, আমাদের অনেক কষ্ট কমে যাবে।”

জোন কমান্ডারের বার্তা

লে. কর্নেল মোঃ মশিউর রহমান সাংবাদিকদের জানান, “পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধিই আমাদের লক্ষ্য। এ ধরনের জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম ভবিষ্যতেও নিয়মিতভাবে অব্যাহত থাকবে।”
তিনি আরও বলেন, নানিয়ারচর জোন শুধু নিরাপত্তা নয়, এলাকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও উন্নয়নমূলক কাজেও পাশে থাকতে বদ্ধপরিকর।

সেনাবাহিনীর মানবিক মুখ

দুর্গম পাহাড়ে যেখানে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র পৌঁছাতে পারছে না, সেখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিজ উদ্যোগে মানুষের দোরগোড়ায় চিকিৎসা পৌঁছে দিচ্ছে। কুড়ামারার এই ক্যাম্প তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্থানীয়রা আশা প্রকাশ করেছেন, এ ধরনের সেবা নিয়মিত চালু থাকলে তাদের জীবনমানে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান কল্যাণমূলক কাজগুলোর মধ্যে- 

বিনামূল্যে চিকিৎসা ক্যাম্প – দুর্গম পাহাড় ও চরাঞ্চলে নিয়মিত মেডিকেল ক্যাম্প, ঔষধ বিতরণ।

শিক্ষা সহায়তা – বই-খাতা, বৃত্তি, পাহাড়ি শিশুদের জন্য স্কুলে পড়ানো।

শীতবস্ত্র বিতরণ – প্রতি বছর হাজার হাজার কম্বল-সোয়েটার।

বৃক্ষরোপণ ও পরিবেশ রক্ষা – লাখ লাখ চারা রোপণ।

বিশুদ্ধ পানি – টিউবওয়েল, সোলার পাম্প স্থাপন।

দুর্যোগে ত্রাণ – বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিধসে প্রথম সাড়া।

রাস্তা-ব্রিজ নির্মাণ – পাহাড়ে শত শত কিলোমিটার রাস্তা।

নারী-যুবক প্রশিক্ষণ – সেলাই, মুরগি-মৌমাছি পালন, বিনা সুদে ঋণ।

খেলাধুলা ও উৎসব – গ্রামে টুর্নামেন্ট, বৈসাবি-সাংগ্রাইয়ে সহযোগিতা।

প্রত্যন্ত এলাকায় “সবার আগে সেনাবাহিনী” – এই কথাটিই তাদের কল্যাণ কাজের সবচেয়ে বড় পরিচয়।

নানিয়ারচর জোন সূত্রে জানা গেছে, আগামীতে আরও বেশি সংখ্যক দুর্গম এলাকায় এ ধরনের মেডিকেল ক্যাম্পেইন পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শুধু দেশের নিরাপত্তা রক্ষা করে না, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও শীর্ষে থাকে। এর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য যে ধরনের মানবিক ও কল্যাণমূলক কাজ করে থাকে।