আট ছানার নিথর দেহ, মা কুকুরের আর্তনাদে কেঁদেছে মানুষ: মামলা দায়ের

ঈশ্বরদীতে আট কুকুরছানাকে বস্তাবন্দি করে পুকুরে ফেলে হত্যা।
মামলা দায়ের, আসামিকে সরকারি কোয়ার্টার ছাড়তে বাধ্য।

টুইট প্রতিবেদক: পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদ সংলগ্ন গেজেটেড কোয়ার্টারে আটটি নবজাতক কুকুরছানাকে নির্মমভাবে বস্তাবন্দি করে পুকুরে ডুবিয়ে হত্যার ঘটনায় এলাকাজুড়ে ক্ষোভের ঝড় বইছে। ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপে অভিযুক্ত পরিবারকে কোয়ার্টার ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।

এদিকে প্রাণী কল্যাণ আইন ২০১৯ অনুযায়ী থানায় মামলা দায়ের হয়েছে।

মামলার বিবরণ

মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) রাতে প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. আকলিমা খাতুন ঈশ্বরদী থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি প্রাণী কল্যাণ আইন ২০১৯–এর ধারা ৭ অনুযায়ী দায়ের করা হয়েছে।

একমাত্র আসামি করা হয়েছে ক্ষুদ্র কৃষক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা হাসানুর রহমান নয়নের স্ত্রী নিশি আকতার (নিশি বেগম)কে। ঈশ্বরদী থানার ওসি আব্দুন নূর মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

হত্যার অভিযোগে নিশি খাতুনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আজ বুধবার (৩ ডিসেম্বর) তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ঘটনার কালক্রম

রবিবার (১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় গেজেটেড কোয়ার্টারে বসবাসরত নিশি আকতার আটটি কুকুরছানাকে বাজারের ব্যাগে ভরে পুকুরে ফেলে দেন বলে অভিযোগ উঠে। মা কুকুরটি রাতভর ছুটোছুটি করে আর্তনাদ করে, খাবার গ্রহণও করেনি।

সোমবার সকালে কোয়ার্টারের কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম ছানাদের খবর জানতে চাইলে নয়ন কিছু জানেন না বলেন। তখন তার ছেলে বলে—“আম্মু ছানাগুলোকে বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলে দিয়েছে।”

পরে পুকুরে বস্তা ভাসতে দেখে উদ্ধার করা হলে তার ভেতর থেকে আটটি মৃত কুকুরছানার লাশ পাওয়া যায়।

সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ

মৃত কুকুরছানার ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়তেই শহরজুড়ে নিন্দা, প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ শুরু হয়। বহু মানুষ জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। ঘটনাটি জাতীয় দৈনিকসহ বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালেও গুরুত্বের সাথে প্রকাশিত হয়।

প্রশাসনের পদক্ষেপ

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনিরুজ্জামান জানান, ঘটনাটি জানার পরই ক্ষুদ্র কৃষক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা হাসানুর রহমান নয়নকে মঙ্গলবারের মধ্যে সরকারি কোয়ার্টার ছাড়ার লিখিত নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে জানা যায়, পরিবারটি বাসা খালি করেছে।

এ ঘটনার পর ঢাকা থেকে এনিমেল অ্যাকটিভিস্ট কমিটির একটি তদন্ত টিম ঈশ্বরদীতে পৌঁছেছে।

মন্ত্রণালয়ের প্রতিক্রিয়া

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার ঘটনাটিকে “অমানবিক” ও “দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণকারী” বলে উল্লেখ করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকও মামলা দায়েরের নির্দেশ দেন।

আসামির বক্তব্য

নিশি আকতার সাংবাদিকদের বলেন—“বাচ্চাগুলো সিঁড়ির পাশে থাকত, ডিস্টার্ব করত। তাই ব্যাগে ভরে সাজিনা গাছের গোড়ায় রেখে এসেছি। পুকুরে কীভাবে পড়েছে জানি না। আমি ফেলিনি।”

তবে তার বক্তব্যের সঙ্গে সাক্ষীদের বিবৃতি সাংঘর্ষিক।

মা কুকুরের অবস্থা

মৃত সন্তান দেখে মা কুকুরটি প্রচণ্ড আর্তনাদ করতে থাকে এবং শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। পরে উপজেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মীরা তাকে চিকিৎসা দেন এবং সেডেটিভ ইনজেকশন প্রয়োগ করেন।

আইন কী বলে? (প্রাণী কল্যাণ আইন ২০১৯, ধারা ৭)

অযথা কষ্ট দেওয়া, নির্যাতন, পঙ্গু করা বা হত্যা— সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ

প্রথম অপরাধ: সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড / ৫০,০০০ টাকা জরিমানা / উভয় দণ্ড

পুনরাবৃত্তি: সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ড + ১ লক্ষ টাকা জরিমানা

এটি জামিনযোগ্য, তবে অ-সমঝোতাযোগ্য (non-compoundable)—অর্থাৎ সমঝোতার মাধ্যমে মামলা এড়ানো যাবে না।

এই ঘটনাটি শুধু একটি প্রাণী হত্যার নয়, বরং প্রাণী কল্যাণ আইন বাস্তবায়ন ও সামাজিক সচেতনতার বড় একটি উদাহরণ হিসেবে সামনে এসেছে। মামলার তদন্ত শুরু হয়েছে। আইন তার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহারের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হবে কি না—এখন সেটিই দেখার বিষয়।