দেশে ফেরার পথে তারেক রহমান, নিরাপত্তা জোরদার: কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখ নেই

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও দেশে ফেরা;
সরকারের নিরাপত্তা আশ্বাস: ‘সবার জন্য প্রস্তুত, কোনো ঝুঁকি নেই’

বদিউল আলম লিংকন: বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি)-এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে সম্ভাব্য ফেরা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ নিরাপত্তা প্রদানের আশ্বাস মিলেছে। মা বেগম খালেদা জিয়াকে সম্প্রতি ‘ভিভিআইপি’ ঘোষণা করে এসএসএফ নিরাপত্তায় দেওয়ার পরও তারেকের নিরাপত্তা ব্যবস্থার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনও গ্রহণ হয়নি।

তবে স্বরাষ্ট্র ও আইন উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, “কোনো নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই; সরকার সবার জন্য প্রস্তুত।”

এই প্রতিবেদনে তারেক রহমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ফেরার পরিকল্পনা, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এবং সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জগুলো আলোচনা করা হলো।

খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য সংকট: দেশে ফেরার প্রধান কারণ

বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য ঝুঁকি তারেক রহমানের দেশে ফেরার প্রধান প্রেরণা। ২৩ নভেম্বর থেকে ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি খালেদা জিয়া হৃদপিণ্ড ও ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে রয়েছেন। ৩০ নভেম্বর রাত থেকে তাঁকে ভেন্টিলেটরে রাখা হয়েছে।

তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ড. এ জেড এম জাহিদ হোসেন ২ ডিসেম্বর দুপুরে সাংবাদিকদের জানান, “খালেদা জিয়া চিকিৎসায় সাড়া দিচ্ছেন এবং নির্ধারিত ট্রিটমেন্ট মেইনটেইন করতে পারছেন। পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে।”

চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী করতে যুক্তরাজ্য ও চীন থেকে বিশেষজ্ঞ টিম এসেছে। ২ ডিসেম্বর সকালে চীনের পাঁচ সদস্যের মেডিক্যাল টিম এভারকেয়ারে পৌঁছে চিকিৎসা বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।

বিশ্ব নেতারাও খালেদা জিয়ার অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ১ ডিসেম্বর টুইট করে বলেন, “বাংলাদেশের জনগণের জীবনে অবদান রাখা বেগম খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য নিয়ে গভীর উদ্বেগ। ভারত সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত।”

এদিকে বিএনপির নেতা-কর্মীরা দেশজুড়ে প্রার্থনার আয়োজন করেছেন। তবে হাসপাতালের চারপাশে ভিড় নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে।

বিএনপি স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ ১ ডিসেম্বর রাতে বলেন, “তারেক রহমান শীঘ্রই দেশে ফিরবেন। মায়ের অবস্থা দেখতে তার অপেক্ষা করা যায় না।”

সরকারের নিরাপত্তা আশ্বাস: ‘সবার জন্য প্রস্তুত, কোনো ঝুঁকি নেই’

তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে সরকারের অবস্থান ইতিবাচক। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) আসিফ নজরুল ২ ডিসেম্বর বলেন, “বাংলাদেশে কারও নিরাপত্তা ঝুঁকি নেই। হোম মিনিস্ট্রি সবার জন্য প্রস্তুত। যাদের বিশেষ নিরাপত্তা প্রয়োজন, তাদের জন্য এসএসএফ বা অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

তিনি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন, খালেদা জিয়াকে দেওয়া এসএসএফ নিরাপত্তা ব্যবস্থা তারেকের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে।

আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ১ ডিসেম্বর বলেন, “তারেকের দেশে ফেরায় কোনো আইনি বাধা নেই। যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকে, সরকার সহযোগিতা করবে এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।”

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন যোগ করেন, “তারেক এখনো ট্রাভেল পাস চাইছেন না, তবে চাইলে একদিনের মধ্যে ইস্যু করা যাবে।”

বিএনপির চেয়ারপারসনের সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার মেজর জেনারেল (অব.) ফজলে এলাহি আকবর বলেন, “তারেকের নিরাপত্তা শুধু দলীয় বাহিনী দিয়ে সম্ভব নয়; সরকারি সমন্বয় দরকার। বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এটি সহজ হয়েছে।”

ফেরার পরিকল্পনা: ডিসেম্বরের মধ্যে, কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখ নেই

২০০৮ সাল থেকে লন্ডনে আত্মগৃহবাসী তারেক রহমান, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তার বিরুদ্ধে দায়ের মামলাগুলোতে খালাস পেয়ে দেশে ফেরার পথ সুগম হয়েছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২ ডিসেম্বর বলেন, “খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল হলে তারেক দ্রুত ফিরবেন।”

ফেরার পূর্বের পরিকল্পনা অনুসারে, তারেক নভেম্বরের শেষ বা ডিসেম্বরের শুরুতে ওমরাহ শেষে সরাসরি ঢাকায় আসবেন। তবে খালেদা জিয়ার অবস্থা এখনো মূল সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করছে। বিএনপির উপদেষ্টা মাহদী আমিন বলেন, “যদি খালেদা জিয়ার অবস্থা সামান্য উন্নত হয়, তাকে লন্ডন নেওয়ার ব্যবস্থা হবে। তখন তারেক ফিরবেন।”

ফেরার প্রস্তুতি চলছে:

আবাসন: ঢাকার গুলশান-১৯৬-এ খালেদা জিয়ার বাড়ির পাশে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। দেওয়াল রংকরণ ও কাঁটাতারের ঘেরা নিরাপত্তা বলয় স্থাপন করা হয়েছে।

কার্যালয়: গুলশান-২-এর ৮৬ নম্বর রোডে চেয়ারপারসনের অফিসে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।

ভোটার রেজিস্ট্রেশন: নির্বাচন কমিশন তারেককে ভোটার তালিকায় যুক্ত করার অনুরোধ পেয়েছে।

গ্র্যান্ড রিসেপশন: বিএনপি ‘ঐতিহাসিক স্বাগত’ের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: নির্বাচনের আগে ফেরার গুরুত্ব

ডিসেম্বরে সম্ভাব্য নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে তারেকের দেশে ফেরা বিএনপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দল তাঁকে ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকায় রেখেছে। বিএনপির পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হুমায়ুন কবীর বলেন, “যদি বিএনপি জয়ী হয়, তারেক প্রধানমন্ত্রী হবেন।”

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সংকেতও নিরাপত্তা আশ্বাসে প্রতিফলিত হয়েছে। জুন ২০২৫-এ লন্ডনে তারেক ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে নির্বাচন ও সংস্কার নিয়ে আলোচনা হয়।

তারেক ৩১ পয়েন্টের ‘রেইনবো বাংলাদেশ’ প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন, যা সকল জাতিগত গোষ্ঠীর অধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এর মাধ্যমে বিএনপির অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে।

সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ-নিরাপত্তা, আইন ও আন্তর্জাতিক বিষয়

যদিও সরকার আশ্বাস দিয়েছে, কিছু চ্যালেঞ্জ এখনও রয়েছে-

নিরাপত্তা: দলীয় বাহিনী যথেষ্ট নয়; রাষ্ট্রীয় সমন্বয় অপরিহার্য। বুলেটপ্রুফ গাড়ি, এসকর্ট এবং কনস্ট্যান্ট মনিটরিং প্রয়োজন।

আইনি: পাসপোর্ট ও ভোটার রেজিস্ট্রেশন সংশ্লিষ্ট ঝামেলা। নির্বাচন কমিশনের অনুমোদন প্রয়োজন।

আন্তর্জাতিক: ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তারেকের বৈঠক ফেরাকে প্রভাবিত করতে পারে।

রাজনৈতিক: ফেরার পর জনসমাবেশ নিয়ন্ত্রণ ও দলীয় ঐক্য রক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।

নিরাপত্তা নিশ্চিত, তবে সিদ্ধান্তে অপেক্ষা

তারেক রহমানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিএনপির প্রতি সরকারের আস্থার প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে। খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের উন্নতি হলে তারেকের দেশে ফেরা নিশ্চিত, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারে। বিএনপি নেতা শায়রুল কবির খান বলেন, “এটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের বিজয়।”

তারেক রহমানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য সকলে অপেক্ষা করছেন।

(তথ্যসূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ঢাকা ট্রিবিউন, দ্য হিন্দু, দ্য ডেইলি স্টার, বিবিসি, এনডিটিভি, উইকিপিডিয়া এবং অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সোর্স থেকে সংগ্রহিত।)