গিনি-বিসাউতে সামরিক অভ্যুত্থান: রাষ্ট্রপতি গ্রেপ্তার

গিনি-বিসাউতে সামরিক অভ্যুত্থান: রাষ্ট্রপতি গ্রেপ্তার, সীমান্ত বন্ধ—রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় পশ্চিম আফ্রিকার ছোট দেশটি।

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: পশ্চিম আফ্রিকার উপকূলীয় দেশ গিনি-বিসাউতে আবারও ঘটেছে সামরিক অভ্যুত্থান। মঙ্গলবার সকালে দেশটির সেনাবাহিনীর একদল উচ্চপদস্থ অফিসার রাষ্ট্রপতি উমারো সিসোকো এম্বালোকে গ্রেপ্তার করে ক্ষমতা দখলের ঘোষণা দেয়।

এবার চতুর্থ সফল অভ্যুত্থানের সাক্ষী হলো দেশটি। এ ঘটনার জেরে রাজধানী বিসাউতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, বন্ধ করে দেওয়া হয় সব সীমান্ত, স্থগিত করা হয় নির্বাচনী প্রক্রিয়া।

অভ্যুত্থানের সময়কাল ও নাটকীয় সকাল

মঙ্গলবার সকাল থেকেই রাজধানী বিসাউয়ের রাষ্ট্রপতি প্রাসাদ ও জাতীয় নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের আশপাশে তীব্র গুলির শব্দ শোনা যায়। সেনারা রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো নিয়ন্ত্রণে নেয় এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, “ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া যান রাস্তায় টহল দিচ্ছিল এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো ঘিরে ফেলা হয়েছিল।”

দুপুর ১টার দিকে রাষ্ট্রপতি এম্বালো তার অফিস থেকে গ্রেপ্তার হন। তিনি ফরাসি ম্যাগাজিন Jeune Afrique-কে ফোনে নিশ্চিত করে বলেন, “আমাকে সেনারা গ্রেপ্তার করেছে। এটি জেনারেল স্টাফের প্রধানের নেতৃত্বে একটি অভ্যুত্থান।”
এ সময় অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী বটচে কান্ডে ও জেনারেল স্টাফের প্রধানকেও আটক করা হয়।

বিকেলে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে হাজির হয়ে সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী অফিসাররা “হাই মিলিটারি কমান্ড ফর দ্য রেস্টোরেশন অব অর্ডার” নামে একটি কাউন্সিল গঠনের ঘোষণা দেয়। তারা জানায়, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হয়েছে, সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান স্থগিত রাখা হয়েছে এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাতিল করা হয়েছে। সীমান্ত বন্ধ, কারফিউ জারি এবং গণমাধ্যমের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।

সেনা-প্রধান দিনিস এন’টচামা এক বিবৃতিতে বলেন, “এটি একটি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া, যেখানে দেশের রাজনীতিবিদ, ড্রাগ সিন্ডিকেট এবং নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার চক্রান্ত ছিল।”

রাজধানীতে উত্তেজনা—কোনো হতাহতের খবর নেই

সন্ধ্যা পর্যন্ত বড় ধরনের সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি। তবে শহরের পরিবেশ থমথমে। ব্রিটিশ দূতাবাস দ্রুত সতর্কতা জারি করে এবং রাশিয়ান দূতাবাস তাদের নাগরিকদের নিরাপদে থাকতে নির্দেশ দেয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম X (টুইটার)-এ জনসাধারণ বলছে, “আফ্রিকার কুপ দেশের তালিকায় গিনি-বিসাউ আবারও নাম লেখাল।”

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনার বিস্ফোরণ

২৩ নভেম্বর দেশটিতে অনুষ্ঠিত হয়েছে রাষ্ট্রপতি ও সংসদীয় নির্বাচন। বর্তমান রাষ্ট্রপতি উমারো সিসোকো এম্বালো দ্বিতীয় মেয়াদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। তবে প্রধান বিরোধী প্রার্থী ডোমিঙ্গোস সিমোয়েস পেরেইরাকে সুপ্রিম কোর্ট মনোনয়ন বাতিল করে।

এম্বালো দাবি করেন, তিনি ৬৫% ভোট পেয়েছেন। কিন্তু বিরোধী প্রার্থী ফার্নান্ডো ডায়াস অভিযোগ করেন, “বাস্তবে জনগণ আমাদেরই বেছে নিয়েছে, নির্বাচন কারচুপি করা হয়েছে।”

ফলাফল ঘোষণার নির্ধারিত দিন ছিল ২৭ নভেম্বর—ঠিক তার আগের দিনই ঘটল অভ্যুত্থান।

দেশটি আন্তর্জাতিক ড্রাগ ট্র্যাফিকিংয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হওয়ায় রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে প্রভাবিত। ২০২২ সালে এম্বালোকে সরাতে দুইবার ব্যর্থ অভ্যুত্থানের চেষ্টা হয়েছিল। সংসদ ভেঙে দিয়ে তিনি নিজে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন, যার জেরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে ওঠে।

অভ্যুত্থানের কারণ: ষড়যন্ত্র, ড্রাগ সিন্ডিকেট ও রাজনৈতিক অবিশ্বাস

সেনাদের দাবি অনুযায়ী অভ্যুত্থানের মূল কারণ, নির্বাচনী ফলাফল প্রভাবিত করার ষড়যন্ত্র, রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ড্রাগ মাফিয়াদের জোট, সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রপতির দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব, প্রশাসনিক অস্থিরতা ও দুর্নীতি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বহু বছরের দুর্বল গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং দেশটির দারিদ্র্য (প্রতি মাথাপিছু জিডিপি মাত্র ৮০০ ডলার) অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

অভ্যুত্থানের প্রভাব: অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অস্থিরতা

সব সরকারি কার্যক্রম স্থগিত, ব্যাংকিং, ব্যবসা-বাণিজ্য ও স্বাস্থ্যসেবায় অচলাবস্থা, জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা

আঞ্চলিক প্রভাব

পশ্চিম আফ্রিকায় সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানগুলো—মালি, নাইজার, বুর্কিনা ফাসো—এর সাথে যোগ হলো গিনি-বিসাউ। ECOWAS এখন বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে।

আন্তর্জাতিক প্রভাব

ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র উদ্বেগ প্রকাশ করছে। পর্তুগাল শান্তি বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে।

আন্তর্জাতিক মহল গিনি-বিসাউয়ের ড্রাগ ট্র্যাফিকিং নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা নিয়ে আরও কঠোর অবস্থান নিতে পারে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

পর্তুগাল: সহিংসতা বন্ধ ও নির্বাচন প্রক্রিয়া বজায় রাখার দাবি।

ব্রিটেন ও রাশিয়া: তাদের দূতাবাস নাগরিকদের সতর্ক থাকতে বলেছে।

ECOWAS ও আফ্রিকান ইউনিয়ন: এখনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না দিলেও বিশেষজ্ঞরা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আসার সম্ভাবনা দেখছেন।

গিনি-বিসাউতে এই সামরিক অভ্যুত্থান দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় আঘাত। পশ্চিম আফ্রিকাজুড়ে চলমান সামরিক শাসনের ধারাবাহিকতা আরও শক্তিশালী হলো। সেনা কাউন্সিল জানিয়েছে, পরিস্থিতি “স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত” তাদের ক্ষমতা অব্যাহত থাকবে।

তবে আন্তর্জাতিক চাপ ও রাজনৈতিক সংকট দেশটিতে নতুন অনিশ্চয়তার দ্বার খুলে দিয়েছে।

পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে—নতুন তথ্য পাওয়া মাত্রই হালনাগাদ জানানো হবে।