নির্মাণ শেষ, তবু চালু নয়: বান্দরবানের ২৫০ শয্যার হাসপাতাল

বান্দরবানের ২৫০ শয্যা হাসপাতাল: নির্মাণ শেষ হলেও চালু নয়—দুর্গম অঞ্চলের লাখো রোগীর ভরসা ভাঙছে।
অসীম রায় (অশ্বিনী), বান্দরবান সংবাদদাতা: চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম জেলা বান্দরবান—যেখানে প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবার জন্য নির্ভর করে সদর হাসপাতালের ওপর।
২০০৫ সাল থেকে ১০০ শয্যায় পরিচালিত হাসপাতালটি দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত চাপ, নাজুক অবকাঠামো, জনবল সংকট ও আধুনিক সেবার অভাবে চিকিৎসাপ্রার্থী মানুষের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে।
এই দুর্ভোগ কমাতে ২০১৯ সালে সরকার হাসপাতালটিকে ১০০ থেকে ২৫০ শয্যায় উন্নীত করার প্রকল্প গ্রহণ করে। ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলেও ২০২৫ সালের নভেম্বর পর্যন্ত নতুন ভবন চালু হয়নি। নানা প্রশাসনিক জটিলতা, জনবল সংকট ও অবকাঠামোগত অসম্পূর্ণতার কারণে এটি এখনো অচল অবস্থায় পড়ে রয়েছে। ফলে জেলার লাখো মানুষের স্বাস্থ্যসেবা আরও সংকটে পড়েছে।
প্রকল্পের ও নির্মাণ অগ্রগতি
২০১৯ সালে ৩৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২৫০ শয্যার আপগ্রেড প্রকল্প হাতে নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নতুন ভবনটিতে আইসিইউ, সিসিইউ, আইসোলেশন ওয়ার্ড, আধুনিক সার্জারি ইউনিট, গাইনি বিভাগসহ পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত চিকিৎসা সেবা স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল।
প্রকৌশল অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণ কাজ নির্ধারিত সময়েই শেষ হয় ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে। তবে এখনো অনুমোদন হয়নি জনবল নিয়োগ, বিদ্যুৎ লাইন সংযোগ, পানির লাইন স্থাপন, সরঞ্জাম চালুর মতো মৌলিক বিষয়। এসব বাধার কারণে নতুন ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে একটি অচল দালান হিসেবে।
এটি শুধু বান্দরবানের সমস্যা নয়—দেশের বিভিন্ন জেলায়ও একই সংকট দেখা গেছে। উদাহরণস্বরূপ: দিনাজপুরের খানসামা ২০ শয্যা হাসপাতাল উদ্বোধনের ৪ বছর পরও চালু হয়নি জনবল ঘাটতি ও বাজেট সংকটে। পঞ্চগড় সদর হাসপাতালের ২৫০ শয্যা উন্নয়ন প্রকল্প বরাদ্দ না পাওয়ায় স্থবির হয়ে আছে।
এসব তথ্য থেকে বোঝা যায়, বান্দরবান স্বাস্থ্য প্রকল্পের বিলম্ব জাতীয় পর্যায়ের প্রশাসনিক জটিলতারই অংশ।
বর্তমান পরিস্থিতি: পুরনো ভবনে অচলাবস্থা ও ভয়াবহ শয্যা সংকট
নতুন ভবন চালু না হওয়ায় এখনো চিকিৎসা চলছে পুরনো ১০০ শয্যার ভবনে। সেখানে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই, নেই আইসিইউ-সিসিইউর সুবিধা। জরুরি অবস্থায় রোগীদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (সিএমসিএইচ) পাঠানো হয়, যা নিজেই অতিরিক্ত রোগীর চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে—২২০০ শয্যার স্থাপনায় প্রতিদিন ৩৩০০ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছেন।
স্থানীয় প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী বান্দরবান সদর হাসপাতালে বর্তমানে রয়েছে, সিনিয়র কনসালটেন্ট: ১২ জনের স্থলে ৪ জন, জুনিয়র কনসালটেন্ট: ২৭ জনের স্থলে ৬ জন, মেডিকেল অফিসার: ৫০ জনের স্থলে মাত্র ১১ জন, নার্স ও স্টাফ সংকটও চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এ ছাড়া হাসপাতালের বাইরের ওয়ার্ড ও করিডোরে ময়লা-আবর্জনার স্তূপ, অপরিচ্ছন্ন টয়লেট, নোংরা পরিবেশে রোগীরা সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকছে।
সদর হাসপাতালের ওয়েবসাইটে (সর্বশেষ আপডেট ২৩ মার্চ ২০২৫) ২৫০ শয্যার তথ্য নেই, যা প্রমাণ করে নতুন ভবন কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি।
রোগীদের দুর্ভোগ: পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের আর্তচিৎকার
স্থানীয় কয়েকজন রোগী ও অভিভাবকের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায় প্রকৃত পরিস্থিতি—
নুর মোহাম্মদ, ছাইগ্যাড় বলেন, “কেবিন তো দূরের কথা, বিছানাই পাই না। মেঝেতে শুয়ে থাকতে হয়। নতুন ভবনটা বন্ধ পড়ে আছে—এটা চালু হলে আমাদের কষ্ট অনেকটাই কমবে।”
সুভাষ দাশ, কালাঘাটা বলেন, “এখানে আইসিইউ-সিসিইউ নেই। ছোট সমস্যা হলেও চট্টগ্রাম যেতে হয়। পথ, টাকা—দুটোই অনেক কষ্টের।”
ছোহ্লামং মার্মা, রুমা বলেন, “স্ত্রীর মাথা ব্যথা, কিন্তু পরীক্ষা করার যন্ত্র নেই। পাহাড়ি এলাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া খরচের ওপর বাড়তি বোঝা।”
এই সাক্ষাৎকারগুলো দেখায়—দুর্গম এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় অনেক ক্ষেত্রে জীবনও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
পরামর্শ ও মতামত
তাৎক্ষণিক জনবল নিয়োগ এবং অনুমোদন প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা।
বিদ্যুৎ, পানি, সরঞ্জাম কার্যক্রম দ্রুত সমন্বয় করে চালু করা।
পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকার জন্য মোবাইল হেলথ ইউনিট বা ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা সেবা চালু করা।
রোগী রেফারেল কমাতে আইসিইউ-সিসিইউ দ্রুত চালুর ওপর জোর দেওয়া।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য: এগোতে পারছে না কাজ, তবু আশাবাদ
বান্দরবানের সিভিল সার্জন ডা. শাহীন হোসেন চৌধুরী বলেন,
“নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলেও বিদ্যুৎ, পানি ও সরঞ্জাম স্থাপনের কিছু কাজ এখনো বাকি। সবচেয়ে বড় সমস্যা—নতুন ভবনের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল অনুমোদন। যখন এসব প্রক্রিয়া শেষ হবে, তখন দ্রুত হাসপাতালটি চালু করা যাবে।”
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২০২৪ সালের নির্দেশিকা অনুযায়ী, একটি পূর্ণাঙ্গ ২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতালে থাকা উচিত ১৩৮ জন ডাক্তার, যার মধ্যে ১০ জন অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট। কিন্তু বান্দরবানে তার অর্ধেকও নেই।
এছাড়া দেশের আরও অনেক জায়গায় কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি আইসিইউ ইউনিট জনবল সংকটে অচল হয়ে আছে—যেমন যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতালের আইসিইউ।
বান্দরবানের ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতাল নির্মাণ শেষ হওয়ার এক বছর পরও চালু না হওয়ায় পুরো জেলার স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এই অচলাবস্থা শুধু একটি জেলার সমস্যা নয়—বরং সারাদেশে স্বাস্থ্য খাতে প্রশাসনিক বিলম্ব, জনবল সংকট ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনার যে বড় চিত্র, তারই প্রতিফলন।






