ফর্টিফিকেশন ও ভোক্তা অধিকার নিয়ে রাজশাহীতে দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ

রাজশাহীতে ‘ফুড ফর্টিফিকেশন ও ভোক্তা অধিকার’ প্রশিক্ষণ: পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে GO-NGO সমন্বয়ের ওপর জোর
মুরাদুল ইসলাম সনেট, রাজশাহী: বাংলাদেশে ভোজ্যতেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যে ফর্টিফিকেশন কার্যক্রম বাস্তবায়ন এবং একই সঙ্গে ভোক্তা অধিকার রক্ষায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সমন্বিত উদ্যোগকে আরও কার্যকর করার লক্ষ্যে অনুষ্ঠিত হলো একদিনব্যাপী বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।
সোমবার (২৪ নভেম্বর) রাজশাহী জেলা প্রশাসকের সেমিনার হলে বাংলাদেশ কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (কেএবি) স্থানীয় কমিটির উদ্যোগে “ফুড ফর্টিফিকেশন ও ভোক্তা অধিকার” শীর্ষক এ প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। কর্মসূচিটি আয়োজন করা হয় গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ইমপ্রুভড নিউট্রিশন (গেইন)-এর সহায়তায়। এতে অংশ নেন স্থানীয় প্রশাসন, বিভাগীয় কর্মকর্তা, খাদ্য উদ্যোক্তা, মিল মালিক ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিরা।
মন্বয়েই নিশ্চিত হবে ভোক্তা অধিকার
প্রশিক্ষণের উদ্বোধনী সেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন কেএবি-এর সভাপতি এএইচএম শফিকুজ্জামান।
তিনি বলেন, “ভোক্তা অধিকার রক্ষায় সরকারি ও অসরকারি সংস্থার সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া কোনো উপায় নেই। ফর্টিফিকেশনের মাধ্যমে খাদ্যে ভিটামিন ও খনিজ যোগ করে অপুষ্টি কমানো যায়, তবে এর জন্য উৎপাদক, বাজারকারী ও ভোক্তাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে।”
বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন রাজশাহী বিভাগের কমিশনার এএনএম বজলুর রশিদ। তিনি জানান,
“বিভাগীয় পর্যায়ে ফর্টিফাইড খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণে কঠোরতা অবলম্বন করা হবে। ভোক্তার অধিকার লঙ্ঘনের কোনো সুযোগ রাখা হবে না।”
অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক আফিয়া আক্তার। তিনি বলেন, “ফর্টিফিকেশন শুধু খাদ্যের পুষ্টিগুণ বাড়ায় না, জনস্বাস্থ্যের ভিত্তি মজবুত করে। রাজশাহী অঞ্চলে ভোজ্যতেল, গমের আটা ও লবণে ফর্টিফিকেশন বাস্তবায়নে আমরা স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি।”
এছাড়া বক্তব্য দেন—ফারুক আহমেদ, প্রতিনিধি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর (ডিএনসিআরপি), জাহুরা শিকদার, বিভাগীয় পরিচালক, বিএসটিআই।
ফর্টিফিকেশন কী এবং কেন প্রয়োজন
প্রশিক্ষণের মূল সেশনে ফর্টিফিকেশনের ধারণা, বাস্তবায়ন পদ্ধতি এবং ভোক্তা অধিকারের সুরক্ষায় এর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন লাইলুন নাহের। তিনি ব্যাখ্যা করেন—
ফর্টিফিকেশন হলো দৈনন্দিন ব্যবহারের খাদ্যপণ্য যেমন ভোজ্যতেল, গমের আটা, লবণ ও চালের সঙ্গে অত্যাবশ্যকীয় ভিটামিন (এ, ডি) এবং খনিজ (আয়োডিন, আয়রন, জিঙ্ক) যুক্ত করা। এটি অপুষ্টি কমানো এবং জনস্বাস্থ্য উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তিনি আরও বলেন, “এখানে ‘গেইন’ বলতে পুষ্টিগুণের লাভ বোঝায়, আর্থিক লাভ নয়।”
বাংলাদেশে ফর্টিফিকেশনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯০-এর দশকে আয়োডিনযুক্ত লবণ চালুর মাধ্যমে।
বর্তমানে, ভোজ্যতেলে ভিটামিন এ ও ডি, গমের আটায় আয়রন ও ফলিক অ্যাসিড, এবং ফর্টিফাইড চাল উৎপাদন চলমান রয়েছে।
ডব্লিউএফপি-এর মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ১৩ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ফর্টিফাইড চাল পাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গেইন এবং মিলার্স ফর নিউট্রিশন কোয়ালিশন বেসরকারি খাতকে ফর্টিফিকেশনকে বাণিজ্যিকভাবে ছড়িয়ে দিতে সহায়তা করছে।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত বাপা ফুড প্রো এক্সপো-তে কোয়ালিশনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়।
চ্যালেঞ্জ ও গবেষণা-নির্ভর তথ্য
প্রশিক্ষণে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়। অক্সফোর্ড পলিসি ম্যানেজমেন্টের এক গবেষণায় দেখা গেছে, লবণ ও ভোজ্যতেল উৎপাদকদের মধ্যে ফর্টিফিকেশনের মান নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা রয়েছে।
ফিউচার স্টার্টআপ-এর ২০২৫ সালের হোয়াইট পেপারে বলা হয়, খাদ্য নিরাপত্তা সংকট মোকাবিলায় ফর্টিফিকেশনের পাশাপাশি কৃষক প্রশিক্ষণ, ক্লাইমেট-স্মার্ট কৃষি এবং ফসল বৈচিত্র্যকরণের ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
স্থানীয় মিল মালিকরা প্রশিক্ষণে বলেন, “মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআই-এর পরীক্ষা আরও বাড়াতে হবে, যাতে ভোক্তারা সহজে মানসম্মত ফর্টিফাইড পণ্য পান।”
ভোক্তা অধিকার: সচেতনতা ও আইন প্রয়োগ
প্রশিক্ষণে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। ডিএনসিআরপি প্রতিনিধিরা জানান, ভোক্তারা যেকোনো অভিযোগ হটলাইন ১৬১২১-এ করতে পারেন।
দেশজুড়ে টাস্কফোর্সের মাধ্যমে বাজার তদারকি জোরদার করা হয়েছে।
মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্য বিক্রির দায়ে সুপারশপগুলোতে নিয়মিত জরিমানা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি নভেম্বর ২০২৫-এ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি সুপারশপকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়—এ তথ্যও উল্লেখ করা হয়।
৫০ জনেরও বেশি স্থানীয় কর্মকর্তা, উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী প্রশিক্ষণে অংশ নেন। শেষে গ্রুপ আলোচনা, প্রশ্নোত্তর এবং বাস্তবায়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। কেএবি-এর স্থানীয় সভাপতি জানান, “এই ধরনের প্রশিক্ষণ রাজশাহীর বাইরে বিভাগের অন্যান্য জেলাতেও আয়োজন করা হবে।”
ভবিষ্যতের পথ: পুষ্টি ও ভোক্তা সুরক্ষার যৌথ অভিযান
ডব্লিউএফপি-এর সর্বশেষ ২০২৫ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী—
২ লাখ ১০ হাজারেরও বেশি শিশু ও গর্ভবতী নারী ইতোমধ্যে ফর্টিফাইড খাদ্যের মাধ্যমে পুষ্টির সুরক্ষা পাচ্ছে।
রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত এই কর্মসূচি ফর্টিফিকেশন বাস্তবায়ন এবং ভোক্তা অধিকার রক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
স্থানীয় প্রশাসন এবং গেইনের সমন্বিত সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে প্রত্যেক ভোক্তাই ভবিষ্যতে নিরাপদ, পুষ্টিকর ও মানসম্মত খাদ্য পাওয়ার নিশ্চয়তা পাবে।







