প্রজেক্ট আলো: দুর্গমে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা

দুর্গম পাহাড়ে আলোর ছোঁয়া: থানচি-রেমাক্রিতে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও শিল্পের উৎসব।

অসীম রায় (অশ্বিনী), বান্দরবান: বান্দরবানের দুর্গম পাহাড়ি উপজেলা থানচি ও রেমাক্রি। যেখানে হাসপাতালের নাম শুনলেও দূরের কথা, ডাক্তারের মুখ দেখাও বিরল। সেই প্রত্যন্ত এলাকায় গত সপ্তাহে পৌঁছে গেল মানবিকতার এক অনন্য দল – ও বন্ধু ‘শুনতে কি পাও’।

দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তারা নিয়ে গেল বিনামূল্যে চিকিৎসা, ওষুধ, নারী স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং শিশু-কিশোরদের জন্য রঙ-তুলির আনন্দময় জগত।

‘প্রজেক্ট আলো’ ও ‘সৃজনে রঙের খেলা’ – এই দুটি কর্মসূচির মাধ্যমে একদিনেই প্রায় ৩০০ মানুষের জীবনে এল নতুন আশা।

চিকিৎসা, বিনামূল্যে ওষুধ

ডা. প্রিয়াঙ্কা নওশীনের নেতৃত্বে ১০ জনের চিকিৎসক দল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে কাজ করেন থানচি ও রেমাক্রি এলাকায়। থানচিতে প্রায় ২০০ এবং রেমাক্রিতে আরও ১০০ জন রোগী পান বিনামূল্যে চিকিৎসা ও প্রয়োজনীয় ওষুধ। ঠান্ডা-কাশি, জ্বর, শরীর ব্যথা, ত্বকের রোগ – এসবই ছিল পাহাড়ি মানুষের নিত্য সঙ্গী। অনেকে মাসের পর মাস চিকিৎসার অভাবে কষ্ট সহ্য করতেন। একদিনের এই ক্যাম্প তাদের মুখে ফুটিয়েছে স্বস্তির হাসি।

নারীদের জন্য বিশেষ উপহার

চিকিৎসার পাশাপাশি নারী স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা সংস্থা ‘রিতু’ আয়োজন করে বিশেষ সচেতনতা কর্মশালা। রেমাক্রি এলাকার ৫০ জন নারীকে দেওয়া হয় পুনর্ব্যবহারযোগ্য স্যানিটারি প্যাড এবং মাসিক স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে শিক্ষামূলক কমিক বই। পাহাড়ে এখনো মাসিককে ঘিরে নানা কুসংস্কার রয়েছে। এই উদ্যোগের মাধ্যমে সেই অন্ধকার ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে। একজন অংশগ্রহণকারী নারী বলেন, “এই প্রথম কেউ এসে আমাদের এসব কথা খোলাখুলি বলল। আমরা লজ্জায় কারো সঙ্গে বলতেও পারি না।”

শিশুদের ক্যানভাসে রঙের উৎসব

শুধু শরীর নয়, মনেরও চিকিৎসা দরকার – এই ভেবেই শিশু-কিশোরদের জন্য আয়োজিত হয় দিনব্যাপী চিত্রশালা ‘সৃজনে রঙের খেলা’। আর্টিস্ট আহমেদ রেজাউল মোস্তফা তানিমের নেতৃত্বে চার সদস্যের আর্ট টিম ৩৫ জন শিশু-কিশোরকে শেখান আঁকার কৌশল, রঙ মেশানোর খেলা এবং মাটির শোপিস তৈরি। শিশুরা যখন নিজেদের হাতে তৈরি করা রঙিন ছবি আর মাটির পুতুল নিয়ে বাড়ি ফিরল, তাদের চোখে-মুখে যে আলো জ্বলছিল, তা দেখে আয়োজকদের চোখও ছলছল করে উঠেছে।

স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের অবদান

দুর্গম এলাকায় এত বড় আয়োজন সহজ ছিল না। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক ঝন্টু কর্মকার ও উত্তম কান্তি দে-র অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সমন্বয়ের কারণেই কর্মসূচি এত সুন্দরভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সংগঠনের পক্ষ থেকে তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানানো হয়েছে।

প্রজেক্ট আলো হলো বাংলাদেশের প্রান্তিক ও দুর্গম এলাকায় (যেমন পাহাড়ি অঞ্চল, হাওর, সীমান্ত) বিনামূল্যে মানসম্মত চিকিৎসা, ওষুধ এবং স্বাস্থ্য সচেতনতা পৌঁছে দেওয়ার একটি মানবিক উদ্যোগ।

এটি পরিচালনা করে মানবিক সংগঠন ও বন্ধু ‘শুনতে কি পাও’ (O Bondhu ‘Shunte Ki Pao’) – একটি অলাভজনক দল যারা ক্রাউডফান্ডিং এবং দানের মাধ্যমে কাজ করে। সংগঠনটি ঢাকা-ভিত্তিক, এবং তাদের টিমে থাকে অভিজ্ঞ চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক এবং স্থানীয় সমন্বয়কারী। সর্বশেষ ক্যাম্পে (২২ নভেম্বর ২০২৫, বান্দরবানের থানচি-রেমাক্রি) নেতৃত্ব দিয়েছেন ডা. প্রিয়াঙ্কা নওশীনের ১০ সদস্যের চিকিৎসক দল। সংগঠনটি স্বচ্ছতা বজায় রাখে – প্রতি ক্যাম্পের হিসাব ফেসবুক এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।

সমন্বিত কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন প্রকল্প ‘শুনতে কি পাও’ ও ফিমেইল হাইজিন পার্টনার ঋতু অরগানাইজেশন-এর উদ্যোগে শুক্রবার (২১ নভেম্বর) থানচি উপজেলা মিনি স্টেডিয়াম ও রেমাক্রী বাজার প্রাঙ্গণে এ কার্যক্রম শুরু হয়।

ও বন্ধু ‘শুনতে কি পাও’ জানিয়েছে, শুধু রোগের চিকিৎসা নয়, মানুষের মনে আলো জ্বালানোই তাদের লক্ষ্য।

স্বাস্থ্যসেবা আর সৃজনশীলতার এই সমন্বিত মডেল ভবিষ্যতেও প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে – এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা বিদায় নিয়েছে পাহাড়ের বুক থেকে।