শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরে আগ্রহী ঢাকা, সবচেয়ে বড় বাধা ভারত

টুইট ডেস্ক: বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে চায় ঢাকা। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সম্প্রতি আদালত এই রায় ঘোষণা করেছে। তবে এই রায় কার্যকরের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত।

শনিবার (২২ নভেম্বর) মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএন-এর এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়েছে।

সিএনএন বলছে, একসময় ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনা ছিলেন একজন বিপ্লবী নেতার কন্যা। ১৯৭০-এর দশকে বাবার নৃশংস হত্যাকাণ্ড তার রাজনীতি জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কিন্তু বহু দশকের রাজনৈতিক উত্থান-অবতরণের পর ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুতি ঘটে তার, এবং শেষ পর্যন্ত তিনি ভারতে পালিয়ে আত্মগোপন করেন। এখন তার অনুপস্থিতিতে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে কেবল তখনই যদি ভারত তাকে ফেরত দেয়।

উত্থান, নির্বাসন ও রক্তাক্ত অতীত:

১৯৭৫ সালের আগস্টে সামরিক অভ্যুত্থানে তার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মা ও তিন ভাই নিহত হন। ঘটনার সময় হাসিনা বোনসহ পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। পরিবারের এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর রাতারাতি নির্বাসিত তিনি ছয় বছর কাটান ভারতে। সেসময় থেকেই ভারতের প্রতি তার আস্থাও আরও দৃঢ় হয়।

১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর লাখো মানুষের ভালোবাসা তাকে রাজনৈতিক শক্তি জোগায়। তখনই শুরু হয় ‘দুই বেগমের লড়াই’ শেখ হাসিনা বনাম খালেদা জিয়া। ১৯৯৬ সালে প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হয়ে তিনি ১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করেন।

২০০৮ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরে তাকে আরও দৃঢ় ও কর্তৃত্ববাদী রূপে দেখা যায়। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি মানবাধিকার লঙ্ঘন, মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ ও বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়নের অভিযোগ বাড়তে থাকে। একই সময়ে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিল্লির কাছে তাকে গুরুত্বপূর্ণ মিত্রে পরিণত করেছিল।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতন:

সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দ্রুত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি দমন-পীড়নে জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়। কিন্তু সহিংসতা আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হয় বরং তা সরকারের পতন ত্বরান্বিত করে। বিশ্লেষক মুবাশ্বর হাসানের ভাষায়, “তিনি দেশ ছাড়লেন এটিই তার অপরাধের স্বীকারোক্তি।

গত বছরের আগস্টে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে হাসিনা ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেন।

মৃত্যুদণ্ডের রায় ও ভারতের ভূমিকা:

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল অনুপস্থিতিতেই তার বিচার করে মৃত্যুদণ্ড দেয়। অভিযোগ- বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে উসকানি দেওয়া, ফাঁসির আদেশ দেওয়া এবং ড্রোন, অস্ত্র ও হেলিকপ্টার ব্যবহার করে দমন-পীড়নের নির্দেশ। আদালত জানায়, শিক্ষার্থীদের হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে তার ভূমিকা “একেবারেই স্পষ্ট”।

রায় ঘোষণার পর আদালত কক্ষে কান্না ও করতালির দৃশ্য দেখা যায়। নিহত এক আন্দোলনকারীর বাবা আবদুর রব বলেন, “এতে একটু শান্তি পেলাম। পুরো শান্তি পাব যখন তাকে ফাঁসির দড়িতে দেখব।”

ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে রায়কে সম্মান জানালেও অবস্থান নিরপেক্ষ রেখেছে। হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ বলেন, “ভারত সবসময় ভালো বন্ধু। তারা আমার মায়ের জীবন বাঁচিয়েছে।”

ভারতের সাবেক কূটনীতিক অনিল ত্রিগুনায়েত বলেন, ভারত তাকে ফেরত পাঠাবে কিনা তা অত্যন্ত অনিশ্চিত। কারণ বাংলাদেশ-ভারত প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী ‘রাজনৈতিক অপরাধে’ কাউকে ফেরত দেওয়া যায় না। ভারত সম্ভবত এই যুক্তিই ব্যবহার করবে। তার মতে, হাসিনা এখনো সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারেন, এমনকি আন্তর্জাতিক আদালতেও যেতে পারেন- তাই ভারত তাড়াহুড়ো করবে না।

রায়ের পরদিন বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিঠি দিয়ে আবারও ভারতের কাছে হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার দাবি জানিয়েছে- “হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়া ভারতের দায়িত্ব।”

আগামী রাজনীতির গতিপথ:

আগামী ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে হাসিনার মৃত্যুদণ্ড দেশের রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। আওয়ামী লীগ এখন নিষিদ্ধ, নেতৃত্বহীন অবস্থায়। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার বিভাজন নিরসনে কঠিন দায়িত্ব পালন করছে। এ সুযোগে বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলও নতুনভাবে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।

আওয়ামী লীগ হয়তো ফিরে আসতে চাইবে, তবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তা সম্ভব নয়। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন- হাসিনার পতন কি এক ‘বিষাক্ত যুগের’ সমাপ্তি, নাকি নতুন অনিশ্চয়তার সূচনা?