তাজরীন ট্রাজেডির ১৩ বছর, হাসপাতাল বানানোর দাবি

টুইট ডেস্ক: এক যুগ পেরিয়ে আলোচিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তাজরীন ট্রাজেডির ১৩ বছর আজ। নিহত শ্রমিকদের স্মরণে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের সেই অভিশপ্ত ভবনের সামনে পালিত হচ্ছে নানা কর্মসূচি। এ কর্মসূচি পালন করছে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও আহত শ্রমিকরা।
দুঃসহ সেই দিনের কথা আজও ভুলতে পারেনি বলে জানান আহত অনেক শ্রমিক। চান জীবনের শেষ বয়সে এসে একটু পূনর্বাসন ও দোষীদের বিচার। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনও।
আজ সোমবার (২৪ নভেম্বর) সকাল থেকেই বিভিন্ন শ্রমিকরা জড়ো হয়েছেন আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের পরিত্যক্ত সেই তাজরীন ফ্যাশন কারখানার ভবন প্রাঙ্গনে। ঘুরে ঘুরে দেখছে সেই ভয়াল অগ্নিকান্ডে ঘটে যাওয়া স্মৃতির রেখা চিহ্নগুলো। আহত শ্রমিকরা যেন খুঁজে ফিরছেন সেই দুঃসহ ভয়াল রাত্রিতে নিজেদের সহকর্মীদের আর্তচিৎকারের আওয়াজ।
জীবন বাঁচাতে সহকর্মীকে মারিয়ে কিভাবে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পরে গিয়েছিলেন সে বর্ণনা দিতেই ডুঁকরে কেঁদে উঠলেন পঞ্চম তলায় অপারেটরের কাজ করা শ্রমিক জরিনা। জানালেন, সেদিনের সেই ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা।
তিনি বললেন, ‘তখন প্রায় সন্ধ্যা পৌনে সাতটা বাজে। হঠাৎ মিসড্ কলের মতো ফায়ার এলার্মের শব্দ। ভাবলাম এ সময়তো ফায়ার ট্রেনিং এর কথা নয়। তাহলে কেন এলার্ম। মনের ভেতর অজানা খটকা বাজে তার। কৌতুহলী মন দৌড়ে তৃতীয় তলায় জানতে যায়। এ সময় সেখানে কারখানা ম্যানেজার রাজ্জাক স্যার ধমক দিয়ে বলে কিছু হলেই তোমরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দাও। কিছু হয়নি কাজ করো গিয়ে। পরে সিঁড়ি দিয়ে উঁকি দিতেই আগুন নিচ থেকে দোতলা পর্যন্ত দেখতে পাই।’
‘ততক্ষণে সবাই নিজের জীবন বাঁচাতে ছুটোছুটি করছে। নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আল-আমীন কেচিগেট তালা দিতে উদ্যত হলে তাকে ধাক্কা দিয়েই ভেতরে চলে যাই। সে গেট তালা দিয়ে সরে পরে। আগুন ছড়িয়ে পরে চারিদিকে। বাঁচতে সকলেই এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছিল। কান্নার রোল চারিদিকে। চারিদিকে ধোয়ার কুন্ডুলি। বিদ্যুৎ বন্ধ। যেন সাক্ষাৎ এক মৃত্যুপুরীতে দাঁড়িয়ে আমি।’
জরিনা আরও বলেন, ‘অনেক সহকর্মীকে টেনে টেনে বের করার চেষ্টা করি। হঠাৎ মনে হলো আমাকেও বের হতে হবে। পাশেই আরেক শ্রমিক মুক্তাকে দেখি। বলি মুক্তা আমি যদি বের হতে না পারি তবে মাকে বলো আমার লাশটা স্যাম্পল রুমে গিয়ে খুঁজতে সেখানেই পাবে। এই বলে হঠাৎ পূর্ব পাশে ফাঁকা দিয়ে নিচে পরে যাই।’
‘কিছুটা জ্ঞান আছে। মানুষের কথার আওয়াজ পাই। বাঁচতে সহযোগিতা চাই তাদের। বলে আওয়াজ পাচ্ছি , কিন্তু আমাকে দেখতে পাচ্ছে না তারা। হাত উঁচু করতে বলে তারা। হাত উঁচু করতে করতেই জ্ঞান হারাই। ১১ দিন পরে হাসপাতালে নিজেকে দেখতে পাই। জানতে পারি অনেকেই মারা গেছে।’
এ বলেই অবিরত চোখের জলে ভাসতে লাগল জরিনা। জানালো, সেই ঘটনায় তার পেছনের হাড় ভেঙ্গে গেছে। কাজ করতে পারে না। সংসার চালাতে অসুস্থ স্বামীই তার এখন একমাত্র ভরসা। চায় একটু পুর্নবাসন। সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা।
শুধু জরিনাই নয়, তার মতো এদিন ক্র্যাচে ভর দিয়ে দিনটি স্মরণে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এখানে এসেছেন হাসান মিয়া। চোখে মুখে প্রচণ্ড ক্ষোভ। সেদিনের ভয়াবহ স্মৃতিচারণ করে জানালেন তিন তলায় কাজ করছিলেন। জানালা ভেঙ্গে কিভাবে যে নিচে পরে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনদিন পর জ্ঞান ফিরে দেখেন হাসপাতালের বেডে। এরপর থেকে জীবন যুদ্ধ শুরু তার।
জরিনা আর হাসান মিয়াদের মতো সেদিন জীবন নিয়ে ফিরে আসা মুক্তা বানু আর নাসিমার অবস্থা ও প্রায়ই একই রকম। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পেয়ে অসুস্থ হয়ে প্রায় অক্ষম অবস্থায় রয়েছে। পরিবারের বোঝা না হয়ে চান সংশ্লিষ্টদের কাছে সহযোগিতা ও পুর্নবাসন। একটু ভালভাবে জীবনের শেষ সময়টাতে বেঁচে থাকায় যার মূল লক্ষ্য।
২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেড কারখানায় সন্ধ্যার দিকে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১১৭ শ্রমিক নিহত হয়। আহত হয় ২ শতাধিক। ওই ঘটনায় মামলা হয়। গ্রেফতার করা হয় কারখানা মালিক দেলোয়ার হোসেনকে। এরপর আর এগোয়নি।
ভয়াবহ এ ঘটনায় আজও যেন নিরব স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাজরীন ভবন। ভবনের ভেতরটা সুনসান নিরবতা। দেয়ালে দেয়ালে আছে আজও আগুনের সেই ক্ষত চিহ্ন। সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই যেন মনে হবে বাঁচার আকুতি নিয়ে শ্রমিকদের কান্না ভেসে আসছে। এখনও জানালার বাঁকানো গ্রীল দেখলেই বোঝা যায় সেদিন জীবন বাাঁচাতে কতইনা চেষ্টা করেছে হতভাগ্য মানুষগুলো। সেসব স্মৃতি সেই অভিশপ্ত পরিত্যক্ত ভবনের পরতে পরতে যেন মিশে আছে।
তাইতো এদিনটা এলে বিচারের দাবিতে ফুঁসে উঠে শ্রমিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলো। গতকাল রাত থেকেই পালন করছে নানা কর্মসূচি। সংগঠনের নেতারা জানান বিভিন্ন দাবিও।
সবুজ বাংলা গার্মেন্টস্ শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ইসমাইল হোসেন ঠান্ডু বলেন, সরকার ও বিজেএমইএ’র কাছে দাবি অবিলম্বে ক্ষতিগ্রমস্তদের ও তার পরিবারকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ যেন দেওয়া হয়। যাতে করে কিছুটা হলেও তারা জীবনধারণ করতে পারে।
জাতীয় গার্মেন্টস্ শ্রমিক ইউনিটির কেন্দ্রীয় সভাপতি ফরিদুল ইসলাম বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের পুনর্বাসন এবং যাদের জন্য এ ঘটনা হলো তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যাতে করে কারও গাফিলতিতে আর এ ধরনের দুর্ঘটনা না ঘটে। এছাড়াও তিনি এই পরিত্যক্ত ভবনটি অধিগ্রহণ করে সংস্কারের মাধ্যমে শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল নির্মাণ করা যায় কিনা তা সংশ্লিষ্টদের দেখতে ও ব্যবস্থা নিতেও দাবি জানান।
আর যেন এমন ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা না ঘটে। সকলেরই চাওয়া দৃষ্টান্তমূলক বিচারের মাধ্যমে দোষীদের শাস্তি হোক।






