বান্দরবানে পিসিসিপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নতুন অঙ্গীকার

বান্দরবানে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদের (পিসিসিপি) ৫ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন: ঐক্য, সংগ্রাম ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার আলোচনা।

অসীম রায় (অশ্বিনী), বান্দরবান: পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষা, শিক্ষা-উন্নয়ন এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে নিরলসভাবে কাজ করে আসা সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ (পিসিসিপি)-এর বান্দরবান জেলা শাখা আজ তার ৫ম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করেছে।

অনুষ্ঠানটি যথাযথ মর্যাদা, উৎসবমুখর পরিবেশ এবং পারস্পরিক সৌহার্দ্যের মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে। কেক কাটা, বিস্তারিত আলোচনা সভা, শুভেচ্ছা বিনিময় এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে মতবিনিময়ের মাধ্যমে দিনটিকে স্মরণীয় করে তোলা হয়।

অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী সেশনে কেক কেটে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়। এরপর বান্দরবান শহরের একটি স্থানীয় হলরুমে আয়োজিত আলোচনা সভায় সংগঠনের পথচলা, বর্তমান চ্যালেঞ্জ এবং আগামী পরিকল্পনা নিয়ে গভীর আলোচনা হয়। সভায় উপস্থিত নেতাকর্মীরা জোর দিয়ে বলেন, পিসিসিপি শুধু একটি ছাত্র সংগঠন নয়, বরং পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালি যুব সমাজের অধিকার আদায়ের একটি শক্তিশালী প্ল্যাটফর্ম।

সংগঠনের ইতিহাস ও পথচলা

পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ (পিসিসিপি) ২০২০ সালে বান্দরবানে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যদিও এর মূল উৎস বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর সাথে যুক্ত, যা ১৯৮৯ সালের ২০ মে ঢাকায় লংগদু গণহত্যার প্রতিবাদে গঠিত হয়েছিল। পিসিসিপি মূলত পার্বত্য অঞ্চলের বাঙালি শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে গঠিত, যারা জাতিগত সংঘাত, শিক্ষা-সুবিধার অভাব এবং সামাজিক বৈষম্যের শিকার।

সংগঠনটি পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি (১৯৯৭) বাস্তবায়নের পক্ষে সোচ্চার, যা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং জাতিগত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার সুরক্ষার লক্ষ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে পিসিসিপি বান্দরবানে নানা কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।

এর মধ্যে রয়েছে, শিক্ষা সহায়তা: দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য বই-খাতা বিতরণ, বিনামূল্যে কোচিং কেন্দ্র চালু এবং বৃত্তি প্রদান।

সামাজিক সচেতনতা: পরিবেশ রক্ষা, নারী শিক্ষা এবং জাতিগত ঐক্য প্রচারণা। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালে বান্দরবান শিশু একাডেমিতে একাদশ-স্নাতক ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানে সংগঠনটি ২০০-এর বেশি নতুন সদস্য যোগ করেছিল।

অধিকার আদায়: কোটা ব্যবস্থায় বাঙালি যুবকদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন, গুচ্ছগ্রামে বন্দি বাঙালিদের মুক্তির দাবি এবং সামরিক নির্যাতনের প্রতিবাদ।

সাম্প্রতিক কার্যক্রম: ২০২৫ সালের জুনে রাঙ্গামাটিতে পিসিপির রাজদ্বীপ আঞ্চলিক ৫ম কাউন্সিলে পিসিসিপির প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করে চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বৃহত্তর আন্দোলনের আহ্বান জানিয়েছিল।

সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি শাহাদাত হোসেন কায়েস এবং সাধারণ সম্পাদক মো. হাবিব আজমের নেতৃত্বে পিসিসিপি বাঙালি যুব সমাজকে শিক্ষিত ও সচেতন করে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।

আলোচনা সভা

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পিসিসিপি বান্দরবান জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক তানভির হোসেন ইমন। তিনি বক্তব্যে বলেন, “পাঁচ বছর মানে শুধু একটি সংখ্যা নয়, এটি আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস, শিক্ষার্থীদের পাশে থাকার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও সুন্দর পার্বত্য চট্টগ্রাম গড়ার অঙ্গীকার। পার্বত্য অঞ্চলে বাঙালি যুবকরা কোটা-সুবিধা থেকে বঞ্চিত, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে পিছিয়ে, আমরা এই অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব।”

সাংগঠনিক সম্পাদক মিছবাহ উদ্দিন, তিনি সংগঠনের সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির উপর জোর দিয়ে বলেন, “আমরা প্রতিটি উপজেলায় শাখা সম্প্রসারণ করে আরও বেশি শিক্ষার্থীকে সংগঠনে আনব।”

রাঙ্গামাটি জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক পারভেজ মোশাররফ,  আঞ্চলিক ঐক্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “পিসিসিপি এবং পিসিপির মধ্যে সহযোগিতা বাড়িয়ে চুক্তি বাস্তবায়নের লড়াইকে তীব্র করতে হবে।”

জেলা যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাফুজুর রহমান সৈকাত, নারী শিক্ষার উপর আলোকপাত করে বলেন, “পার্বত্য অঞ্চলে নারী শিক্ষা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ প্রচারণা চালু করব।”

বান্দরবান সরকারি মহিলা কলেজ শাখার সভাপতি রুমি দাশ: তিনি নারী অধিকারের প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা নারী শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়নের জন্য ডিজিটাল শিক্ষা প্রশিক্ষণ চালু করব।”

সভায় জেলা ও উপজেলা শাখার প্রায় ১৫০-এর বেশি নেতাকর্মী অংশগ্রহণ করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নাগরিক পরিষদের প্রতিনিধিরা, যারা জাতিগত ঐক্যের উপর জোর দেন।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, আরও সুসংগঠিত হয়ে এগিয়ে যাওয়া

আলোচনায় নেতৃবৃন্দ আগামী এক বছরের জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এর মধ্যে রয়েছে,

শাখা সম্প্রসারণ: বান্দরবানের প্রতিটি উপজেলায় (যেমন আলিকদম, রোঙ্গোকুইডি) নতুন শাখা গঠন এবং ৫০০-এর বেশি নতুন সদস্য যোগ।

শিক্ষা উন্নয়ন: দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তি কার্যক্রম চালু, ডিজিটাল লাইব্রেরি স্থাপন এবং বিনামূল্যে অনলাইন কোচিং।

সামাজিক কর্মসূচি: নারী ক্ষমতায়নের জন্য বিশেষ ওয়ার্কশপ, পরিবেশ সচেতনতা ক্যাম্পেইন এবং গুচ্ছগ্রামে বাঙালি সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার জন্য আইনি সহায়তা।

আন্দোলনমুখী কার্যক্রম: পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বৃহত্তর জাতীয় আন্দোলনের অংশ হিসেবে রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ির সাথে যৌথ কর্মসূচি।

তানভির হোসেন ইমন বলেন, “ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করলে আমরা ভবিষ্যতে শিক্ষার্থীদের সেবা এবং নেতৃত্ব প্রদানে আরও সফল হব। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।”

উৎসবমুখর সমাপ্তি

আলোচনা শেষে নেতাকর্মীদের মধ্যে মিলনমেলা, স্মৃতিকথা আদান-প্রদান এবং গ্রুপ ফটোগ্রাফির মাধ্যমে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। সবাই একসঙ্গে স্লোগান দিয়ে বলেন, “শিক্ষার অধিকার, জাতিগত ঐক্য—পিসিসিপি এগিয়ে যাবে!”

পিসিসিপি নেতৃবৃন্দ সকল শিক্ষার্থী, যুব ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের সংগঠনে যোগদানের আহ্বান জানান। অনুষ্ঠানটি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে সকলে অভিমত প্রকাশ করেন।