মাধুপুর ফল্ট: বাংলাদেশের সক্রিয় ভূতাত্ত্বিক ঝুঁকির কেন্দ্রবিন্দু

মাধুপুর ফল্ট: বাংলাদেশের একটি সক্রিয় ভূতাত্ত্বিক ফল্ট লাইন!

টুইট প্রতি‌বেদক: বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় অংশে অবস্থিত মাধুপুর ফল্ট দেশের অন্যতম সক্রিয় ও বিপজ্জনক ভূমিকম্পপ্রবণ ফল্ট লাইন হিসেবে পরিচিত। ইন্ডিয়ান ও ইউরেশিয়ান প্লেটের সংঘর্ষস্থলে অবস্থানের কারণে এই ফল্টটি দীর্ঘদিন ধরেই বিশেষজ্ঞদের নজরে।

২১ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুভূত ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পটিও এই ফল্টের সক্রিয়তার সরাসরি প্রভাব বলে মনে করছেন ভূতত্ত্ববিদরা। ফলে মাধুপুর ফল্টকে কেন্দ্র করে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক অবস্থা

মাধুপুর ফল্টটি মধ্য বাংলাদেশে অবস্থিত মাধুপুর ট্র্যাক্ট অঞ্চলের সঙ্গে সম্পর্কিত, যা প্লিস্টোসিন যুগের উঁচু ভূমি। এটি একটি ব্লাইন্ড থ্রাস্ট ফল্ট, অর্থাৎ ফল্ট লাইনটি ভূপৃষ্ঠের নিচে লুকিয়ে থাকে এবং সরাসরি দেখা না গেলেও ভূপৃষ্ঠের ওপর তার প্রভাব অত্যন্ত সুস্পষ্ট। প্রায় ১৫০ কিলোমিটার বিস্তৃত এই ফল্ট টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ ও ঢাকার দিকে প্রসারিত হয়েছে। মাধুপুর ক্লে নামক প্লিস্টোসিন মাটির ওপর গঠিত এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে টেকটোনিক অস্থিরতা লক্ষ্য করা যায়। ফল্ট বরাবর বিভিন্ন স্থানে ফল্ট স্কার্প, স্তরচ্যুতি এবং ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন দেখা গেছে, যা এর সাম্প্রতিক সক্রিয়তার প্রমাণ বহন করে।

ঐতিহাসিক ও সাম্প্রতিক ভূমিকম্প কার্যকলাপ

এই ফল্ট শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ভূমিকম্পগুলোর উৎস হিসেবে চিহ্নিত। ১৮৮৫ সালের বাংলা ভূমিকম্প (প্রায় ৭.০ মাত্রা) মাধুপুর ফল্টের সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে মনে করা হয়, যা বৃহত্তর মানিকগঞ্জ অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি করে। এছাড়া ১৮৯৭ সালের মহান ভূমিকম্প এবং ১৫৪৮ সালের কম্পনও এই ফল্ট অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতেও ফল্টটি নীরব থাকেনি। ২০০৮ সালে টাঙ্গাইল অঞ্চলে ছোট মাত্রার কম্পন রেকর্ড করা হয়। সর্বশেষ ২১ নভেম্বর ২০২৫-এর ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্প, যার উপকেন্দ্র ছিল মধবদী–মাধুপুর অঞ্চল, বিশেষজ্ঞদের মতে এই ফল্টের চাপ মুক্তিরই ফল। ঢাকায় বহু ভবনে ফাটল সৃষ্টি, আতঙ্কে মানুষের হতাহতের খবর এবং পরবর্তী আফটারশকের সম্ভাবনা—সবই মাধুপুর ফল্টের সক্রিয়তাকে আরও স্পষ্ট করে।

ঝুঁকি ও সম্ভাব্য প্রভাব

বাংলাদেশের সিসমিক জোনিং ম্যাপ অনুযায়ী, মাধুপুর ট্র্যাক্ট সিসমিক জোন–২, অর্থাৎ মাঝারি ঝুঁকির অঞ্চলে পড়ে। কিন্তু ফল্টটির ঢাকার নিকটবর্তী অবস্থান—মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরত্বে—রাজধানীকে বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, মাধুপুর ফল্টে যদি আবারও ৭.৫ মাত্রার একটি বড় ভূমিকম্প ঘটে, তবে ঢাকা শহরে হাজার হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে এবং বিপুল সংখ্যক প্রাণহানির আশঙ্কা রয়েছে। বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, এই মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকায় ৭০,০০০’র বেশি ভবন ধসে যেতে পারে এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে ১০০–১০০০ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত। ঢাকার নরম ও কম শক্তির মাটি ভূমিকম্পে ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা

ভূতত্ত্ববিদদের মতে, ইন্ডিয়ান প্লেটের উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়া এবং বার্মিজ মাইক্রোপ্লেটের সঙ্গে সংঘর্ষ—এই দুটি প্রক্রিয়াই মাধুপুর ফল্টকে ক্রমাগত চাপের মুখে রাখছে। বিশেষজ্ঞ হুমায়ুন আখতার বলেছেন, “এই অঞ্চলের ফল্টগুলো যেকোনো সময় সক্রিয় হয়ে বড় ধরনের ভূমিকম্প সৃষ্টি করতে পারে।” অন্যদিকে গবেষকরা বলছেন, মাধুপুর অঞ্চলে সাম্প্রতিক স্তরচ্যুতি, ভূপৃষ্ঠের উঁচু-নিচু পরিবর্তন ও নতুন লাইনামেন্টস বড় ধরনের ভূমিকম্পের ইঙ্গিত বহন করছে।

সতর্কতা ও প্রস্তুতির পরামর্শ

জাতীয় পর্যায়ে ভবন নির্মাণে সিসমিক কোড কঠোরভাবে প্রয়োগ, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পুনর্গঠন, জরুরি উদ্ধার সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সিসমিক ম্যাপ আপডেট করা জরুরি। সাধারণ মানুষকে ভূমিকম্পের সময় নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ, গ্যাস–বিদ্যুৎ সংযোগ পরীক্ষা এবং পরিবারসহ প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

মাধুপুর ফল্ট বাংলাদেশের ভূমিকম্প ঝুঁকির একটি কেন্দ্রবিন্দু। সাম্প্রতিক ভূকম্পন এই ঝুঁকির বাস্তবতা আরও স্পষ্ট করেছে। তাই জাতীয় ও ব্যক্তিগত উভয় পর্যায়ে প্রস্তুতি নেওয়াই ভবিষ্যতের সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবিলার একমাত্র পথ।