রাজশাহীতে ৯৫ কোটি টাকা নিয়ে উধাও ১৮ সমবায় সমিতি: ভুক্তভোগীদের করণীয় কি?

রাজশাহীর বাগমারায় সমবায় সমিতির নামে বিশাল প্রতারণা: ৯৫ কোটি টাকা নিয়ে উধাও ১৮টি সমিতি।
ভুক্তভোগীদের জন্য ৭টি ছোট করণীয়-থানায় ৪২০/৪০৬ মামলা করুন। গ্রুপ মামলা করলে দ্রুত ফল। সমবায় অফিসে লিখিত অভিযোগ দিন। জেলা প্রশাসকের কাছে ভোক্তা অধিকারে যান। সব রসিদ-কাগজ সংরক্ষণ করুন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে সবাইকে জড়ো করুন। মিডিয়াকে জানান, চাপ বাড়ান।
বিশেষ প্রতিবেদক: রাজশাহীর বাগমারা উপজেলায় ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’সহ অন্তত ১৮টি সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের জীবনভর সঞ্চিত অর্থ হাতিয়ে নিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, এসব সমিতিতে প্রায় ২৩০০ গ্রাহকের অন্তত ৯৫ কোটি টাকা আমানত জমা ছিল, যা এখন পর্যন্ত ফেরত মেলেনি।
সমিতিগুলোর অফিস বন্ধ, সাইনবোর্ড ঝুলছে শুধু, আর প্রতারক চক্রের সদস্যরা পলাতক। এ ঘটনায় থানায় একাধিক অভিযোগ দায়ের হলেও কোনো অগ্রগতি নেই, ফলে হতাশায় ডুবে আছেন ভুক্তভোগীরা।
ভুক্তভোগীদের দুঃখের গল্প: সারা জীবনের সঞ্চয় এক নিমেষে শেষ
বাগমারার একডালা গ্রামের খোদেজা বেগম (৬৫) বছরের পর বছর ঘরে ঘরে কাজ করে ও হাঁস-মুরগি পালন করে চার লাখ টাকা জমিয়েছিলেন। বার্ধক্যে একটি পাকা বাড়ি করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। সমিতির লোকজন এসে বলেছিল, “পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণ হয়ে যাবে।” সেই প্রলোভনে সব টাকা জমা দেন ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’ সমিতিতে। আজ তিনি নিঃস্ব। “যারা আশ্বাস দিয়েছিল, তারা কোথায়? অফিসও বন্ধ। আমার স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল,” কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন খোদেজা বেগম।
একই উপজেলার শাহানাজ বেগমের অবস্থাও করুণ। তিনি ও তাঁর স্বজনেরা মিলে ৩৩ লাখ টাকা জমা রেখেছিলেন বিভিন্ন সমিতিতে। এর মধ্যে এক স্বজনের অবসরভাতার টাকাও ছিল। প্রথম দিকে মাসিক-ত্রৈমাসিক মুনাফা দিয়েছে, কিন্তু হঠাৎ সব বন্ধ। “থানায় অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। আমরা এখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে,” বলেন শাহানাজ।
ভুক্তভোগীদের মধ্যে রয়েছেন কৃষক, শিক্ষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা, দিনমজুর—সব শ্রেণির মানুষ। কেউ ২৮ লাখ, কেউ তো কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত জমা রেখেছিলেন। কেউ কেউ বলছেন, একটি সমিতিতে একাই ৩ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করা হয়েছে।
প্রতারণার কৌশল: প্রথমে মুনাফা দিয়ে আস্থা, পরে লাপাত্তা
সমিতিগুলোর কৌশল ছিল একই। প্রথমে মাসিক ১০-১৫ শতাংশ বা বার্ষিক প্রতি লাখে ২০ হাজার টাকা মুনাফার লোভ দেখাত। কয়েক মাস মুনাফা দিয়ে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করত। তারপর বড় অঙ্কের আমানত নিত। মেয়াদ শেষ হলে “দ্বিগুণ টাকা ফেরত” বা “বিশেষ প্রকল্পে আরও লাভ”—এমন প্রলোভন দেখিয়ে টাকা আটকে রাখত। শেষ পর্যন্ত অফিস গুটিয়ে চলে যেত প্রতারকরা।
ভুক্তভোগীরা জানান, এসব সমিতির পেছনে একটি প্রভাবশালী চক্র কাজ করত। তারা স্থানীয়ভাবে পরিচিত লোকজনকে এজেন্ট বানিয়ে গ্রাহক সংগ্রহ করত।
সমবায় দপ্তরের দায়: নিবন্ধন সহজ করায় বিপদ?
সমবায় দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাগমারায় মোট ৩০৩টি সমবায় সমিতির নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের পর নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করায় প্রতারক চক্র সুযোগ নেয়। ২০১৯ সালে একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় অনেক সমিতি নিবন্ধন পায়। কিন্তু অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় মাত্র দু’বছরের মধ্যে প্রকল্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।
বর্তমানে অভিযোগের পর দুই দফায় ৬৮টি সমিতির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। প্রায় ১০০টি সমিতি কালো তালিকাভুক্ত। কিন্তু এতেও প্রতারণা থামেনি। সমবায় দপ্তরের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, নজরদারির অভাব ও নিবন্ধন প্রক্রিয়ার দুর্বলতাই এর মূল কারণ।
আইনি পদক্ষেপ ও বর্তমান অবস্থা
ভুক্তভোগীরা বাগমারা থানায় একাধিক মামলা ও জিডি করেছেন। কিন্তু পুলিশের তদন্তে খুব একটা অগ্রগতি নেই। প্রতারকদের অনেকেই এলাকা ছেড়েছেন। কেউ কেউ দেশের বাইরে পালিয়েছেন বলে গুঞ্জন আছে। সমবায় দপ্তর থেকে বলা হচ্ছে, বাতিলকৃত সমিতিগুলোর সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়ার চেষ্টা চলছে—কিন্তু অধিকাংশ সমিতির কোনো সম্পদই নেই।
প্রতারণা থেকে শিক্ষা
বাগমারার এ ঘটনা বাংলাদেশে সমবায় সমিতির নামে চলা প্রতারণার একটি বড় উদাহরণ। দেশের বিভিন্ন স্থানে এরকম শত শত সমিতি হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে উচ্চ মুনাফার লোভে টাকা জমা না দেওয়া, নিবন্ধন যাচাই করা এবং সমবায় দপ্তরের কঠোর নজরদারি একমাত্র সমাধান।
বাগমারার হাজার হাজার ভুক্তভোগী এখনো আশায় বুক বেঁধে আছেন—কবে তাদের রক্ত-ঘামের টাকা ফিরে পাবেন। কিন্তু সেই আশা ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। এ এক ‘উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ’ থেকে চরম দুঃস্বপ্নের গল্প।
সমবায় প্রতারণা মামলায় প্রযোজ্য আইন ও শাস্তি
বাগমারায় যেসব সমবায় সমিতি উচ্চ মুনাফার লোভ দেখিয়ে ৯৫ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র হলো দণ্ডবিধির ৪২০ ধারা (প্রতারণা) এবং ৪০৬ ধারা (আমানতের টাকা আত্মসাৎ)। এ দুটি ধারা একসঙ্গে প্রয়োগ করলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং জরিমানা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুলিশ এই দুই ধারাতেই মামলা নেয়।
যদি দেখা যায় সমিতির লোকেরা জাল সনদ, জাল রসিদ বা জাল নিবন্ধনপত্র ব্যবহার করেছে, তাহলে দণ্ডবিধির ৪৬৮ (জালিয়াতি) ও ৪৭১ (জাল কাগজ ব্যবহার) ধারা যোগ হয়। এতে শাস্তি যাবজ্জীবন পর্যন্ত হতে পারে।
প্রতারকদের মধ্যে যদি পরস্পরের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্র প্রমাণিত হয় (যেমন: একজন এজেন্ট, একজন চেয়ারম্যান, একজন টাকা পাচারকারী), তাহলে ধারা ১২০খ (অপরাধী ষড়যন্ত্র) যোগ হবে এবং সবাইকে মূল অপরাধের সমান শাস্তি পেতে হবে।
সমবায় সমিতি আইন ২০০১-এর ধারা ৯১ অনুযায়ী, শুধু সদস্য নয়—বাইরের লোকের কাছ থেকে আমানত নেওয়া, এফডিআর বা দ্বিগুণ স্কিম চালানো একেবারেই নিষিদ্ধ। এই অপরাধে সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা জরিমানা এবং ৭ বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে। এছাড়া সমিতির নিবন্ধন বাতিল হয় এবং সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা যায়।
যদি প্রতারকরা টাকা বিদেশে পাচার করে থাকে, তাহলে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ধারা ৪ অনুযায়ী ৪ থেকে ১২ বছরের কারাদণ্ড এবং টাকার দ্বিগুণ জরিমানা হতে পারে।
ভুক্তভোগীরা যদি থানায় মামলা না নেয়, তাহলে আদালতে সরাসরি দণ্ডবিধির ১৫৬(৩) ধারায় মামলা করতে পারেন। এছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এর ধারা ৭৬ অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের কাছে অভিযোগ করলে প্রতারকদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
এ ধরনের প্রতারণায় কোনো ছাড় নেই। ৪২০/৪০৬ ধারায় মামলা হলে আসামিরা গ্রেপ্তার হলে সহজে জামিন পান না। তাই ভুক্তভোগীরা দ্রুত থানায় এজাহার দায়ের করলে প্রতারকদের ধরা সম্ভব।






