বান্দরবানে ৭৫০ নারী উদ্যোক্তাকে ৫৯ লাখ টাকা দিলো বিএনকেএস

বান্দরবানে ৭৫০ নারী উদ্যোক্তাকে নগদ অর্থ সহায়তা: বিএনকেএস-এর উদ্যোগে দুর্গম এলাকায় নারী ক্ষমতায়নের নতুন অধ্যায়।
অসীম রায় অশ্বিনী বান্দরবান: বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের দুর্গমতম এলাকায় নারীদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে এনজিও সংস্থা বলিপাড়া নারী কল্যাণ সমিতি (বিএনকেএস) ৭৫০ জন নারী উদ্যোক্তাকে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করেছে।
এই সহায়তা বিতরণ কার্যক্রম ১৭ নভেম্বর সোমবার সকাল থেকে বান্দরবানের থানচি উপজেলার রেমাক্রী এবং তিন্দু ইউনিয়নের প্রাঙ্গণে পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই উদ্যোগটি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে পরিচালিত ‘সহনশীল জীবিকার জন্য সহায়তা’ (PRLC) প্রকল্পের অংশ, যা চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি) অঞ্চলে দারিদ্র্য হ্রাস এবং জীবিকা নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চালু হয়েছে।
প্রকল্পের উদ্দেশ্য
PRLC প্রকল্পটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) অর্থায়নে এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (MJF) এর নেতৃত্বে ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে চলমান। যুক্তরাষ্ট্র উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত সহায়তায় এটি পরিচালিত হচ্ছে। প্রকল্পের মোট বাজেট ৮ মিলিয়ন ইউরো (প্রায় ৯০ কোটি টাকা), যা রাঙামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়ির মতো তিনটি পাহাড়ি জেলায় ৯৮,০০০ জনের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের লক্ষ্য রাখে। এর মধ্যে বিশেষভাবে দরিদ্র পরিবার, নারী এবং শিশু-কিশোরীদের জীবিকা প্রচার, পুষ্টি সেবা সম্প্রসারণ, সম্প্রদায়িক সংগঠন এবং বাজার উন্নয়নের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
বান্দরবানের থানচি উপজেলা সিএইচটি অঞ্চলের অন্যতম দুর্গম এলাকা, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন, দুর্যোগ এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে নারীদের জীবিকা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। বিএনকেএসের মতো স্থানীয় অংশীদার সংস্থাগুলো এই প্রকল্পের মাধ্যমে ৮টি এনজিও-র সাথে যৌথভাবে কাজ করছে। প্রকল্পের লক্ষ্য হলো চরম দারিদ্র্যের মুখোমুখি পরিবারগুলোকে স্থায়ী আয়ের উৎস সৃষ্টি করে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করা, বিশেষ করে নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে। এটি সিএইচটি অঞ্চলে বাড়তে থাকা শিশু অপুষ্টি, পানীয় জলের সংকট এবং লিঙ্গ অসমতার মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বিতরণ অনুষ্ঠানে মোট ৫৯ লাখ ৫৮ হাজার ২০০ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।
এর মধ্যে, ১১৮ জন উদ্যোক্তাকে: প্রত্যেককে ১০,১০০ টাকা করে মোট ১১ লাখ ৯১ হাজার ৮০০ টাকা।
৬৩২ জন উদ্যোক্তাকে: প্রত্যেককে ৭,২০০ টাকা করে মোট ৪৭ লাখ ৬৬ হাজার ৪০০ টাকা।
এই সহায়তা রেমাক্রী ইউনিয়নের ৪১৫ জন এবং তিন্দু ইউনিয়নের ৩৩৫ জন নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে সমানভাবে বিতরণ করা হয়েছে।
এই অর্থগুলো প্রধানত পশুপালন-ভিত্তিক উদ্যোগ (হাঁস, মুরগি, ছাগল এবং শুকর পালন) শুরু বা সম্প্রসারণের জন্য ব্যবহার করা হবে। বিএনকেএস-এর কর্মকর্তারা জানান, এই নারী উদ্যোক্তাদের গ্রুপ করে গত এক মাস ধরে বিস্তারিত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। প্রশিক্ষণে পশুপালনের মৌলিক বিষয়, রোগ নিরোধক চিকিত্সা, ঔষধ ব্যবস্থাপনা এবং বাজার যোগাযোগের উপর জোর দেওয়া হয়েছে। এই প্রশিক্ষণগুলো গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থা (গ্রাউস)-এর মতো সহযোগী সংস্থাগুলোর সাথে যৌথভাবে পরিচালিত হয়েছে, যা সিএইচটি অঞ্চলে নারী ক্ষমতায়নের জন্য কাজ করে আসছে।
এই উদ্যোগটি শুধু অর্থ সহায়তা প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি নারীদের পরিবারিক স্বচ্ছলতা এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য রাখে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে—২০১৯-২০ অর্থবছরে এটি ২ লাখ ছাড়িয়েছে—কিন্তু দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় অর্থায়ন এবং প্রশিক্ষণের অভাব এখনও একটি চ্যালেঞ্জ।
PRLC প্রকল্প এই ফাঁক পূরণ করে স্থানীয় নারীদের ব্যবসায়িক দক্ষতা বাড়িয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে তাদের অবদান বৃদ্ধি করবে।
অনুষ্ঠানে উপস্থিতি এবং স্থানীয় সহযোগিতা
রেমাক্রী ইউনিয়ন পরিষদ প্রাঙ্গণ এবং তিন্দু বাজার প্রাঙ্গণে আয়োজিত দুটি পৃথক অনুষ্ঠানে উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের মনিটরিং কর্মকর্তা কায়সার জিলানী, প্রকল্প সমন্বয়কারী আলোপ্রিয় চাকমা, গ্রান্ট ম্যানেজার এবিএম গোলাম সারওয়ার, ডেপুটি ম্যানেজার-গ্রান্টস আমানুল্লাহ নূরী, টেকনিক্যাল অফিসার কথিকা খীসা এবং রেমাক্রী ইউপি চেয়ারম্যানের প্রতিনিধি হ্লাথোয়াইপ্রু মারমা উপস্থিত ছিলেন। বিএনকেএস-এর প্রকল্প সমন্বয়কারী পেশন চাকমা, ফিন্যান্স ডাইরেক্টর আবামং মারমা, ফিন্যান্স ম্যানেজার মাম্যাসিং মারমা, অ্যাডমিন অফিসার চাইসামং মারমা এবং টেকনিক্যাল অফিসার হ্লাগ্যউ মারমা সহ মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।
এছাড়া, দুই ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী মেম্বার, ওয়ার্ড মেম্বার এবং পাড়া-করবাড়ি হেডম্যানরা স্থানীয় সহযোগিতা প্রদান করেছেন। এই স্থানীয় নেতৃত্বের সমর্থন PRLC প্রকল্পের সাফল্যের জন্য অপরিহার্য, যা সম্প্রদায়-ভিত্তিক উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়।
ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
এই সহায়তা বিতরণের মাধ্যমে বিএনকেএস এবং PRLC প্রকল্প সিএইচটি অঞ্চলে নারীদের ক্ষমতায়নের একটি নতুন মাইলফলক স্থাপন করেছে। প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক শাহীন অনামের মতে, এটি পাহাড়ি জেলাগুলোতে জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তবে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব (যেমন অকাল বর্ষা এবং খরা) এবং বাজার অ্যাক্সেসের অভাব এখনও চ্যালেঞ্জ। বিএনকেএসের নির্বাহী পরিচালক হ্লা শিং নুয়ের মতে, এই নারীদের জন্য আরও প্রশিক্ষণ এবং যন্ত্রপাতি সরবরাহের প্রয়োজন, যাতে তারা বান্দরবানের প্রধান শহরে সহজে অ্যাক্সেস পান।
এই উদ্যোগটি বাংলাদেশের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা (যেমন এসডিজি ৫: লিঙ্গ সমতা) এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা নারী উদ্যোক্তাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে।






