রাজশাহীতে জজপুত্র হত্যা: লিমনের ভাইরাল স্বীকারোক্তি – ফাঁসির দাবি

রাজশাহীতে জজের ছেলে হত্যা: পরকীয়া জড়িত লোমহর্ষক নাটক, ভাইরাল সাক্ষাৎকারে ক্ষোভ—পুলিশের অবহেলায় ৪ সদস্য বরখাস্ত; অপরাধীর কঠোর শাস্তি ও ফাঁসির দাবিতে জনরোষ।
টুইট প্রতিবেদক: রাজশাহী মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আব্দুর রহমানের নবম শ্রেণির ছাত্র ছেলে তাওসিফ রহমান সুমনের (১৬) নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেশের মানুষকে শোক ও ক্ষোভে স্তব্ধ করে দিয়েছে। হত্যার সঙ্গে সরাসরি জড়িত অভিযুক্ত লিমন মিয়ার (৩৫) হাসপাতালে পুলিশ হেফাজতে দেওয়া সাক্ষাৎকার ভাইরাল হওয়ায় পুলিশের অবহেলা ঘিরে বিতর্ক আরও ঘনীভূত হয়েছে।
এই ঘটনায় রাজপাড়া থানার চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্তে উঠে এসেছে পরকীয়া, আর্থিক লেনদেন, প্রতারণা, ড্রাগ আসক্তি ও হুমকির ভয়াবহ ইতিহাস। সর্বসাধারণের দাবি—দ্রুত বিচার এবং লিমনের মৃত্যুদণ্ড।
ঘটনার লোমহর্ষক বিবরণ
গত বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) দুপুর আড়াইটার দিকে রাজশাহীর ডাবতলা এলাকার একটি ভাড়া বাসায় এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। পরিবারটি সেখানে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছিল। অভিযুক্ত লিমন মিয়া নিজেকে জজের ভাই পরিচয় দিয়ে বাসায় প্রবেশ করেন। দারোয়ান মেসের আলী তার নাম ও মোবাইল নম্বর লিখে ঢুকতে দেন।
গৃহের ভেতরে ঢুকেই লিমন সরাসরি জজের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসীর (৪৪) সঙ্গে দেখা করতে চান। কথোপকথনের এক পর্যায়ে লিমন হঠাৎ ছুরি বের করে লুসীকে আক্রমণ করেন। মাকে রক্ষা করতে এগিয়ে গেলে তাওসিফকে ওড়না দিয়ে শ্বাসরোধ করা হয় এবং ছুরি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে—তাওসিফের গলায় স্পষ্ট শ্বাসরোধের দাগ, ডান পায়ের আঙুলে ধারালো অস্ত্রের আঘাত, এবং লুসীর পেটে ও ঊরুতে একাধিক ছুরিকাঘাত।
প্রায় ৩০ মিনিট পর গৃহকর্মীর চিৎকারে প্রতিবেশীরা বাসায় ঢুকে তিনজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) নিয়ে যান। সেখানে পুলিশ লিমনকে গ্রেফতার করে হেফাজতে নেয়। লুসীর অস্ত্রোপচার শেষে অবস্থা স্থিতিশীল, কিন্তু তাওসিফ ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। অভিযুক্তের সঙ্গে থাকা ব্যাগ থেকে হত্যায় ব্যবহৃত ছুরি উদ্ধার করা হয়।
আসামি লিমন মিয়ার পরিচয় ও হত্যার মোটিভ
লিমন মিয়া গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার মদনীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি বিএনপির স্থানীয় নেতা এবং প্রাক্তন ইউপি সদস্য এসএম সৈয়দ সৈয়দের (ফুলছড়ি উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক) দ্বিতীয় ছেলে।
তার সম্পর্কে জানা যায়—এসএসসি পাস, গাইবান্ধা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি, সেনাবাহিনীতে ৭-৮ বছর সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে চাকরি—২০১৮ সালে চাকরি ছাড়েন, শেয়ার ব্যবসা ও বালুর ব্যবসায় যুক্ত, গুরুতর ড্রাগ আসক্ত এবং কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনে রিহ্যাবে ভর্তি। সেখানেই ৫ বছর আগে লুসীর সঙ্গে পরিচয়। লুসীর দয়া ও সহানুভূতিকে পুঁজি করে আর্থিক সাহায্য নেওয়া হয়। সময়ের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়, কিন্তু লুসী যোগাযোগ বন্ধ করলে লিমন ভয়াবহ হুমকি দিতে শুরু করে।
মূল মোটিভ: পরকীয়া সম্পর্ক, প্রতারণা, আর্থিক লোভ এবং প্রতিহিংসা।
৩ নভেম্বর লিমন ফেসবুক মেসেঞ্জারে লুসীকে হত্যার হুমকি দেন। ৬ নভেম্বর লুসী সিলেটের জালালাবাদ থানায় জিডি করেন, কিন্তু আদালতের অনুমতি না পাওয়ায় তদন্ত শুরু হয়নি। এ অবহেলাই পরে সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
হাসপাতালে ভাইরাল সাক্ষাৎকারে নতুন প্রশ্ন
পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন লিমনকে এক বেসরকারি টিভি চ্যানেল সাক্ষাৎকার নিতে সক্ষম হয়। এটি ব্যাপক ক্ষোভ সৃষ্টি করেছে।
লিমনের স্বীকারোক্তি—”লুসীকে টি-বাথে নিয়ে যাওয়ার চাপ দিতে গিয়ে সুমন এসে আমাকে আঘাত করে, তখন আমি তাকে পায়ে কামড় দিই। এরপর কিছু মনে নেই। দেশবাসীর কাছে বিচার চাই।” এটি ছিল খুনির কৌশলগত সাক্ষাৎকার বলে মনে করা হচ্ছে।
তিনি আরও বল”বলেছিলাম এক মিনিট কথা বলেন, এরপর ভুলে যাইয়েন…”
তার এই স্বীকারোক্তি সমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। মানুষের দাবি—অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড ও পুলিশী দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা হোক।
পুলিশের অবহেলা: ৪ সদস্য বরখাস্ত
সাক্ষাৎকারের সুযোগ করে দেওয়ায় আরএমপি কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান শনিবার (১৫ নভেম্বর) রাজপাড়া থানার চার পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করেন। তারা হলেন—এসআই আবু শাহাদাত, কনস্টেবল আব্দুস সবুর, কনস্টেবল মাহফুজার রহমান, কনস্টেবল মিঠু সরদার।
তাদের থানা থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। আরও কেউ জড়িত থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন আরএমপির মুখপাত্র এসিসি গাজিউর রহমান।
আদালতও কমিশনারকে শো-কজ নোটিশ পাঠিয়েছে। পূর্বের জিডি তদন্ত শুরু না হওয়াকে বড় অবহেলা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
তদন্তের অগ্রগতি
একাধিক টিম তদন্তে নেমেছে। লিমনকে হাসপাতালে থেকে ছাড়া দিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
লিমনের ফোন ও সোশ্যাল মিডিয়া রেকর্ড জব্দ করা হয়েছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন কমিশনার।
লুসীর জিডির তদন্তও পুনরায় শুরু
পুলিশ জানায়, প্রতিটি দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে—পরকীয়া, আর্থিক লেনদেন, রাজনৈতিক যোগাযোগ, ড্রাগ অভ্যাস, পরিকল্পিত হত্যার সম্ভাবনা সবই তদন্তাধীন।
জনপ্রতিক্রিয়া: কঠোর শাস্তি ও ফাঁসির দাবিতে ক্ষোভ।
দেশজুড়ে এ ঘটনায় শোক ও ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। সামাজিক মাধ্যম উত্তাল—মানুষ বলছে, “একটি নিরপরাধ শিশুকে হত্যা, একজন মাকে নৃশংসভাবে আহত—এই হত্যাকারীর একটাই শাস্তি হওয়া উচিত, ফাঁসি।”
“পুলিশের অবহেলা না হলে এ ঘটনা হয়তো ঘটত না।”
বিএনপির স্থানীয় নেতারা লিমনের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে নীরব। জজের পরিবার শোকাহত, এখনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেননি। লুসীর পরিবার বলেছে “মানুষের উপকার করতে গিয়ে এমন ভয়াবহ পরিণতি হবে ভাবিনি।”
এই ঘটনায় বিজেসা শুক্রবার (১৫ নভেম্বর) এক বিবৃতি দিয়ে ফাঁসির দাবি তুলেছে। সভাপতি মো. আমিরুল ইসলাম ও মহাসচিব মুহাম্মদ মাজহারুল ইসলাম সই করে বলা হয়েছে, “এমন নৃশংসতার জন্য আসামিকে অবিলম্বে ফাঁসির সাজা দিতে হবে।”
দুটি মূল দাবি: ১) সব আদালত, বিচারকের বাসস্থান ও যাতায়াতে অবিলম্বে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা বাহিনী নিয়োগ; ২) রাজশাহী হত্যা ঘটনায় দ্রুত বিচার ও ফাঁসি প্রদান। দাবি না মানলে রবিবার থেকে নিম্ন আদালতে কাজ বন্ধের হুমকি দেওয়া হয়েছে।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ঘটনার নিন্দা করে দ্রুত ব্যবস্থার নির্দেশ দিয়েছেন।
নৃশংস হত্যা নিয়ে দেশজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বিচারকদের সংগঠন বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেসা) পক্ষ থেকে। তারা সরকারের কাছে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছে—দাবি না মানলে রবিবার (১৭ নভেম্বর) থেকে নিম্ন আদালতগুলোতে কলমবিরতি হবে।
সামাজিক মাধ্যমে #JusticeForTawfique #HangLimanMiah হ্যাশট্যাগে ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে, যদিও সরাসরি প্রতিবাদের খবর এখনও আসেনি।
এই হত্যাকাণ্ড শুধু একটি পরিবার নয়—পুরো রাজশাহীসহ দেশের মানুষের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। পরকীয়া, ড্রাগ আসক্তি, ব্ল্যাকমেইল, পুলিশের অবহেলা সব মিলিয়ে এটি এক ভয়াবহ বাস্তব চিত্র। সকলের দাবি—দ্রুত বিচার, সর্বোচ্চ শাস্তি এবং ফাঁসি।






