সম্পর্ক ভাঙায় ছেলের জীবন শেষ? বিচারকের পরিবারের ভয়ংকর সত্য কি!

  • কোয়ান্টামের ‘ফ্রেন্ডশিপ’ থেকে হত্যা: লিমনের কথা শুনলে চমকে উঠবেন!
  • আর্থিক দাবি অস্বীকারে ফেসবুক হুমকি, তারপর খুন।

রাজশাহীতে নৃশংস হত্যাকাণ্ড: বিচারকের বাসায় ঢুকে ছেলেকে কুপিয়ে খুন, স্ত্রী গুরুতর আহত—কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিচয়, সম্পর্কের জটিলতায় প্রতিহিংসা?

টুইট প্রতি‌বেদক: রাজশাহী মহানগর ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আব্দুর রহমানের ভাড়া বাসায় ঢুকে তার ছেলে তাওসিফ রহমান সুমনকে (১৮) ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে এক দুর্বৃত্ত। এ সময় বিচারকের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসিকে গুরুতর আহত করা হয়।

বৃহ:বার (১৩ নভেম্বর) বিকেল আড়াইটা দিকে নগরীর ডাবতলা তেরখাদিয়া এলাকার স্পার্কভিউ ভবনে এই ঘটনা ঘটে। পুলিশ হামলাকারী লিমন মিয়া (৩৫, গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলা)-কে আহত অবস্থায় আটক করেছে। লিমন সেনাবাহিনীতে সেবা দিয়ে ২০১৮ সালে চাকরি ছাড়েন এবং স্থানীয় ব্যবসায় যুক্ত ছিলেন। তিনি চোখের সমস্যায় ভুগছিলেন এবং ঢাকায় চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন বলে পরিবারের দাবি।

ঘটনার পরপরই পুলিশের দ্রুত অভিযানে লিমনকে হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বলেন, “হামলাকারীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ঘটনার পুরো রহস্য উদঘাটন করা হবে। প্রাথমিকভাবে পুরনো শত্রুতা, আর্থিক দাবি অস্বীকার ও জিডির প্রতিহিংসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে।” তদন্তে পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিট, ক্রাইম সিন ইউনিট এবং কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সঙ্গে যোগাযোগের রেকর্ড খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিচারক আব্দুর রহমান তখন আদালতে কর্তব্যে ছিলেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কীভাবে ঘটল হামলা?

ভবনের দারোয়ান মেসের আলীর বর্ণনায়, লিমন মিয়া বিকেল সাড়ে ২টার দিকে ভবনে আসেন। নিজেকে বিচারকের ভাই পরিচয় দিয়ে নাম ও মোবাইল নম্বর লিখিয়ে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন। প্রায় ৩০ মিনিট পর ফ্ল্যাট থেকে চিৎকার ও হট্টগোলের শব্দ শুনে দারোয়ান ছুটে যান। তখন দেখা যায়, লিমন ছুরি হাতে সুমনকে (স্থানীয় স্কুলছাত্র) একাধিকবার কুপিয়ে ফেলেছেন। সুমন ঘটনাস্থলেই মারা যান। তাসমিনকে উদ্ধার করে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (রামেক) নেওয়া হয়, যেখানে তাঁর শরীরে অস্ত্রপচার চলছে। হামলাকারী লিমন পালানোর সময় আহত হয়ে পড়েন এবং পুলিশের হাতে আত্মসমর্পণ করেন।

হাসপাতালের মুখপাত্র শংকর কুমার বিশ্বাস জানান, “তাসমিন নাহারের অবস্থা গুরুতর কিন্তু স্থিতিশীল। তাঁর শরীরে একাধিক ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। আটক যুবককেও চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।” নিহত সুমনের মরদেহ মর্গে রাখা হয়েছে পোস্টমর্টেমের জন্য।

নেপথ্যের ঘটনা: কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, আর্থিক সাহায্য ও প্রতিহিংসা

পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে লিমন মিয়া বলেন,

পরিচয়ের শুরু: “কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্য হিসেবে তাসমিন নাহারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমরা একই জেলা (গাইবান্ধা) থেকে হওয়ায় যোগাযোগ সহজ হয়। পরিচয়ের পর তাঁর মোবাইল নম্বর নিয়ে কথা বলতে শুরু করি।”

সম্পর্কের বিকাশ: “আমাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি আমাকে বিভিন্ন সময় আর্থিক সাহায্য করতেন।”

ক্ষোভের জন্ম: “সম্প্রতি তিনি সময় দিতে চাননি। মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করলে অস্বীকার করায় ফেসবুকে হুমকি দিই। কথাবার্তায় কাটাকাটি শুরু হয়। তিনি যোগাযোগ বন্ধ করার চেষ্টা করলে ক্ষোভ তৈরি হয়। গত ৬ নভেম্বর তিনি সিলেটের জালালাবাদ থানায় আমার বিরুদ্ধে জিডি করেন, যা আমাকে প্রতিহিংসাপরায়ণ করে তোলে।”

সিলেটের জালালাবাদ থানার ওসি শাহ মোহাম্মদ মোবাশ্বির বলেন, “লিমনের বক্তব্যে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে পরিচয় ও সম্পর্কের কথা উঠে এসেছে। কিন্তু কিছুদিন ধরে মহিলা তাকে সময় না দেওয়ায় ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।” আরএমপি কমিশনার যোগ করেন, “লিমন পরিবারের পূর্বপরিচিত। মাঝে মাঝে আর্থিক দুরবস্থার কথা বলে টাকা চাইতেন। দু-একবার সাহায্য করা হলেও, সম্প্রতি অস্বীকার করায় ফেসবুকে হুমকি দেন এবং সরাসরি বাসায় আসেন।”

জিডিতে তাসমিন উল্লেখ করেন, “লিমন আমার নম্বর নিয়ে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করছেন এবং হুমকি দিচ্ছেন।” জিডির মাত্র ৭ দিন পর এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) গাজিউর রহমান বলেন, “লিমন তাসমিনের পূর্বপরিচিত। বাসায় ঢুকে প্রথমে তাঁর সঙ্গে কথা বলছিলেন। কথাকাটাকাটির পর ছেলেকে আক্রমণ করেন। তদন্তে এই বক্তব্য যাচাই করা হচ্ছে।”

প্রতিক্রিয়া: প্রধান বিচারপতির নিন্দা ও তদন্তের নির্দেশ
সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ গভীর শোক প্রকাশ করে বলেন, “বিচার বিভাগের একজন সদস্যের পরিবারের ওপর এ নৃশংস আক্রমণ নিন্দনীয়, অমানবিক এবং বেদনাদায়ক। এমন নৃশংসতা বিচার ব্যবস্থার উপর আঘাত।” তাঁর নির্দেশনায় সুপ্রিম কোর্ট ঘটনার সকল অগ্রগতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং দ্রুত, সুষ্ঠু তদন্ত ও কঠোর শাস্তির জন্য নির্দেশ দিয়েছে।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেছেন, “এমন ঘটনা বিচার ব্যবস্থার উপর আঘাত। ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা থেকে এমন ঘটনা ঘটলে সমাজের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কঠোর শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।” স্থানীয় বাসিন্দারা শোক প্রকাশ করেছেন এবং বিচারকদের নিরাপত্তার দাবি জানিয়েছেন।

এ পর্যন্ত আরও কোনো গ্রেপ্তারির খবর পাওয়া যায়নি, তবে পুলিশ লিমনের সঙ্গে যুক্ত অন্যদের খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে। তদন্ত চলমান, এবং লিমনের চিকিৎসা শেষে আরও বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ হবে।

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান বলেন, “লিমনের চিকিৎসা শেষ হলে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। মামলায় ধারা ৩০২ (হত্যা), ৩২৬ (গুরুতর আঘাত) এবং ৫০৬ (হুমকি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তদন্তকারী দল ক্রাইম সিন ইউনিটের সঙ্গে কাজ করছে।” তদন্তে লিমনের সেনাবাহিনী থেকে ছাঁটাই (২০১৮) এবং স্থানীয় বিএনপি নেতা বাবার সঙ্গে যোগাযোগও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

এই ঘটনা বিচারকদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন প্রশ্ন তুলেছে এবং সরকারি-বেসরকারি স্তরে তদন্তের দাবি বাড়ছে। সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে দ্রুত ন্যায়বিচারের আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।