বিএনপির ২৩ আসনে কোন্দল: প্রার্থী পরিবর্তনের আভাস

বিএনপির প্রার্থী তালিকায় অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন: ২৩ আসনে তীব্র বিরোধ, পরিবর্তনের আভাস।

টুইট প্রতি‌বেদক: বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনপি) এবারের ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতিতে ২৩৭টি আসনে একক প্রার্থী ঘোষণা করলেও, তালিকা ঘিরে দলের অভ্যন্তরে তীব্র টানাপোড়েন দেখা দিয়েছে। গত ৩ নভেম্বর গুলশানে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭টি আসনের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেন।

কিন্তু ঘোষণার পর থেকেই অন্তত ২৩টি আসনে বিক্ষোভ, মানববন্ধন, মশাল মিছিল এবং এমনকি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। দলীয় সূত্র জানায়, এসব আসনে মনোনয়নবঞ্চিত প্রভাবশালী নেতারা শক্ত অবস্থান নিয়ে প্রার্থী পুনর্মূল্যায়নের দাবি তুলেছেন। বিএনপির হাইকমান্ড এখন নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রার্থীদের মাঠপর্যায়ের কর্মকাণ্ড যাচাই করছে, যার ফলে কয়েকটি আসনে পরিবর্তন আসতে পারে।

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, “কয়েকটি আসনে ক্ষোভ হতেই পারে। এসব আমরা ভালোভাবে হ্যান্ডল করছি। ফাঁকা সব আসন মিত্রদের জন্য রাখা হবে না; কিছু আসনে শিগগিরই দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করা হবে।”

এছাড়া, মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, “যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে কোনো কোনো আসনে পরিবর্তন আনা হতে পারে।” দলীয় নীতিনির্ধারকরা জানান, “ধানের শীষের বিজয়ের স্বার্থে প্রয়োজন হলে মনোনয়ন পরিবর্তনেও দ্বিধা করবে না।”

অভ্যন্তরীণ টানাপোড়েন

বিএনপি এবার প্রার্থী নির্বাচনে সতর্কতা অবলম্বন করেছে। তালিকা তৈরিতে পেশাদার সার্ভে, স্থানীয় জনপ্রিয়তা এবং সাম্প্রতিক আন্দোলনের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ৮৩ জন তরুণ প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, যাদের অনেকেই রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। কিন্তু মহিলা প্রার্থী মাত্র ১০ জন এবং সংখ্যালঘু প্রার্থী মাত্র ৪ জন, যা সমালোচনার মুখে পড়েছে। “যারা গত ১৫-১৬ বছর ধরে সংগ্রাম করেছেন, যারা কারারুদ্ধ, নির্যাতিত হয়েছেন—তাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে,” বলেছেন মির্জা ফখরুল।

তবে, ঘোষণার পর সাতক্ষীরা, ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, নাটোর, নারায়ণগঞ্জ, মেহেরপুর, রংপুর, কক্সবাজারসহ অন্তত সাতটি জেলায় বিক্ষোভ শুরু হয়।

ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর) আসনে দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন এবং অন্তত আটজন আহত। মুন্সীগঞ্জ সদরে গুলিতে আরেকজন হত্যার শিকার হয়েছেন।

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) এবং চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে সড়কে টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। দলের কেন্দ্রীয় দফতর বিভাগ কয়েকজন নেতাকে বহিষ্কার করেছে। বিশ্লেষক কেএম মহিউদ্দিন বলেন, “যারা প্রাথমিক তালিকায় নেই তারাও দলীয় সিদ্ধান্ত মানতে রাজি নন। এ কারণেই সংঘাত সহিংসতা হচ্ছে এবং নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়তে পারে।”

২৩ আসনে তীব্র বিরোধ

দলীয় সূত্র অনুসারে, ঘোষিত তালিকার মধ্যে অন্তত ২৩টি আসনে তীব্র বিরোধ তৈরি হয়েছে। এসব আসনে মনোনয়নবঞ্চিত নেতারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন, যা ভোট বিভাজনের আশঙ্কা বাড়িয়েছে।

ক‌য়েক‌টি আসনে উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে

সাতক্ষীরা-২ (সদর-দেবহাটা): প্রার্থী আবদুর রউফের মনোনয়ন বাতিলের দাবিতে ১২টি ইউনিয়নের ৩৩ জন নেতা আবেদন করেছেন। তারা ত্যাগী নেতা আব্দুল আলিমকে প্রার্থী করার দাবি তুলেছেন।

সাতক্ষীরা-৩ (কালীগঞ্জ-আশাশুনি): ডা. শহিদুল আলমকে বাদ দিয়ে কাজী আলাউদ্দীনকে মনোনয়ন দেওয়ায় স্থানীয় বিএনপি বিক্ষোভ মিছিল করেছে।

ময়মনসিংহ-৩ (গৌরীপুর): প্রার্থী এম ইকবাল হোসেন ও বঞ্চিত আহম্মেদ তায়েবুর রহমানের সমর্থকদের সংঘর্ষে আটজন আহত; একজন নিহত।

ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া): আখতারুল আলমের পরিবর্তে আব্দুল করীম সরকারকে প্রার্থী করার দাবিতে বিক্ষোভ।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (আখাউড়া-কসবা) ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ (নবীনগর): প্রার্থী পুনর্বিবেচনার দাবিতে মানববন্ধন; ২০১৮-এর প্রার্থী কাজী নাজমুল হোসেনের সমর্থকরা অবরোধ করেছেন।

সিলেট-৪ (গোয়াইনঘাট-জৈন্তাপুর-কোম্পানীগঞ্জ): আবদুল হাকিম চৌধুরীকে মনোনয়ন দেওয়ার দাবিতে হাজারো নেতার মশাল মিছিল।

হবিগঞ্জ-৪ (চুনারুঘাট-মাধবপুর): ছাত্রদল নেতারা এসএম ফয়সালের পরিবর্তে শাম্মী আক্তারকে দাবি করেছেন; উপজেলা নেতারা প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।

রংপুর-৩: মহানগর আহ্বায়ক সামসুজ্জামান সামুর মনোনয়নের বিরুদ্ধে মাহফুজ উন নবীর সমর্থকরা গণমিছিল করেছে।

কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ): শাহজাহান চৌধুরীর পরিবর্তে আবদুল্লাহকে প্রার্থী করার দাবিতে বিক্ষোভ।

নাটোর-১ (লালপুর-বাঘাতিপাড়া): প্রয়াত ফজলুর রহমান পটলের মেয়ে ফারজানা শারমিন পুতুলকে মনোনয়ন দেওয়ায় ত্যাগী নেতা তাইফুল ইসলাম টিপু ও ইয়াছির আরশাদের সমর্থকরা বিক্ষোভ করেছে; ভাই-বোনের বিরোধের কারণে পরিবর্তনের সম্ভাবনা।

নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার): মনোনয়নবঞ্চিত কেন্দ্রীয় নেতারা একমঞ্চে এসে পরিবর্তন দাবি করেছেন।

মেহেরপুর-২ (গাংনী): আমজাদ হোসেনের পরিবর্তে জেলা সভাপতি জাভেদ মাসুদকে দাবিতে আন্দোলন; সংঘর্ষে ১০ জন আহত।

চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড): চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে অবরোধ এবং টায়ারে আগুন।

চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি): কর্নেল (অব.) আজিম উল্লাহ বাহারকে বাদ দেওয়ায় সড়কে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ।

অন্যান্য: নরসিংদী-৪, মুন্সীগঞ্জ-২ (সংঘর্ষে গুলিতে হত্যা; সাবেক এমপি মিজানুর রহমান সিনহার মনোনয়ন নিয়ে বিরোধ), ঠাকুরগাঁও-৩, নোয়াখালী-৫ (পূর্বে জামায়াত প্রার্থী ছিলেন), রাজশাহী-৪ ও ৫, ফেনী-২ (জয়নাল আবদীনের বয়সজনিত সমস্যা), মাদারীপুর-১ (কামাল জামান মোল্লাহের মনোনয়ন স্থগিত), সিলেট-৩ (যুক্তরাজ্যভিত্তিক নেতা মোহাম্মদ আব্দুল মালেকের মনোনয়ন নিয়ে সমালোচনা)।

অন্যান্য সম্ভাব্য সংঘাতপূর্ণ আসন: নীলফামারী-১, ঝিনাইদহ-২, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২, ঠাকুরগাঁও-২, দিনাজপুর-৫, লালমনিরহাট-২, নওগাঁ-৫, নাটোর-৩, সিরাজগঞ্জ-১, পাবনা-১, খুলনা-১, পটুয়াখালী-২, টাঙ্গাইল-৫, ময়মনসিংহ-১০, কিশোরগঞ্জ-১, মানিকগঞ্জ-১, গাজীপুর-১, নরসিংদী-৩, রাজবাড়ী-২, কুমিল্লা-২, বরিশাল-৩, চট্টগ্রাম-৩, ৬, ৯, ১১, কক্সবাজার-২।

স্বতন্ত্র প্রার্থিতার আশঙ্কা ও নিরপেক্ষ যাচাই

মনোনয়নবঞ্চিত কয়েকজন নেতা, যেমন যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী, উপ-অধ্যক্ষ শামসুজ্জামান দুড়ু, যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভি, ইত্যাদি স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। একটি বড় রাজনৈতিক দলও তাদের প্রার্থী করতে আগ্রহী। এতে ভোট বিভাজনের ভয়ে হাইকমান্ড তালিকা পুনর্বিবেচনা করছে।

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, “এরপরেও যেটুকু হয়েছে সেটুকু আমরা দলীয়ভাবেই সমাধান করছি। আশা করি শিগগিরই সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে কাজ করবেন।”

দলটি নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান দিয়ে প্রার্থীদের বঞ্চিত নেতাদের সঙ্গে আচরণ যাচাই করছে। যাচাই শেষে পরিবর্তন আসতে পারে।

মাদারীপুর-১-এ কামাল জামান মোল্লাহের মনোনয়ন স্থগিত হয়েছে বিক্ষোভের কারণে। বিএন‌পি চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, “যে কোনো আসন থেকে যাকে মনোনয়ন দিলেও, সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের বিজয় নিশ্চিত করুন। অভ্যন্তরীণ বিবাদের সুযোগ দেবেন না।”

ফাঁকা আসন ও মিত্রদের জন্য ছাড়

২৩৭ আসনের বাইরে ৬৩টি আসন এখনো ফাঁকা। এর মধ্যে অন্তত ১১টিতে শিগগির প্রার্থী ঘোষণা হবে: ঢাকা-৯, ১৮, ২০; মাদারীপুর-২; গাজীপুর-১; টাঙ্গাইল-৫; চট্টগ্রাম-৬, ৯, ১১; ঝিনাইদহ-৪; সিরাজগঞ্জ-১। বাকি আসনগুলো মিত্রদের জন্য ছাড়া হতে পারে। চলতি মাসের শেষে গুলশানে শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হবে।

মিত্রদের জন্য সংরক্ষিত আসন: হবিগঞ্জ-১, সুনামগঞ্জ-২, ৪; সিলেট-৪, ৫; লক্ষ্মীপুর-১, ৪; ঢাকা-৭, ৯, ১০, ১৮, ২০; নারায়ণগঞ্জ-৪; চট্টগ্রাম-১৪, ১৫; নড়াইল-২; যশোর-৫; ঝালকাঠি-১; বগুড়া-২ (নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না); পটুয়াখালী-৩ (গণঅধিকার পর্ষদের নুরুল হক নুর); পিরোজপুর-১ (জাতীয় পার্টির মোস্তফা জামাল হায়দার); কিশোরগঞ্জ-৫ (জাতীয় দলের সৈয়দ এহসানুল হুদা); ঢাকা-১৩ (এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ); ঢাকা-১৭ (আন্দলীব রহমান পার্থো); ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ (গণসমহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি); কুমিল্লা-৭ (এলডিপির রেদোয়ান আহমেদ)। জামায়াতে ইসলামীকে এবার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা হচ্ছে, যদিও ২০১৮-এ ২২ আসন ছাড়া হয়েছিল।

দলের অবস্থান: ঐক্যের আহ্বান

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ফেনী, দিনাজপুর ও বগুড়া থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, যদিও তাঁর স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করবে। অভিনয়কারী চেয়ারম্যান তারেক রহমান বগুড়া-৬ থেকে লড়বেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খান্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “আমাদের যৌথ আন্দোলনের মিত্ররা নির্ধারিত আসনে প্রার্থী হবেন। বাকিটা চূড়ান্ত করছি।” দলের নীতি: “এক নেতা, এক আসন”—পারিবারিক রাজনীতি এড়াতে।

দলীয় নেতারা বলছেন, এই টানাপোড়েন সামাল না দিলে নির্বাচনে প্রভাব পড়তে পারে। কিন্তু ঐক্য গঠনের দায়িত্ব মনোনয়নপ্রাপ্তদের দেওয়া হয়েছে। যদি ব্যর্থ হন, তাহলে পরিবর্তন অনিবার্য। বিএনপির এই সংকট মোকাবিলা করে নির্বাচনে শক্তিশালী অবতরণের চ্যালেঞ্জ এখন।