রাজশাহীতে বিচারকের ছেলে হত্যাকাণ্ড: বিচারব্যবস্থায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন

  • পুরনো হুমকির জেরে রক্তাক্ত হামলা, তদন্তে পারিবারিক শত্রুতার ছায়া
  • বিচারকের পরিবারে শোক, দেশের বিচারব্যবস্থায় নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন

মুরাদুল ইসলাম স‌নেট: রাজশাহী মহানগর ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আব্দুর রহমানের ছেলে তাওসিফ রহমান সুমনকে (সূত্রভেদে বয়স ২০ থেকে ২৫ বছর) নিজ বাসায় ঢুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে।

এ সময় বিচারকের স্ত্রী তাসমিন নাহার লুসী গুরুতর আহত হন এবং হামলাকারী নিজেও আহত অবস্থায় ধরা পড়েন।

পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে একটি পুরনো পারিবারিক বিরোধের সূত্র—সিলেটে মাত্র সাত দিন আগে দায়ের করা একটি জেনারেল ডায়েরি (জিডি), যাতে হত্যার হুমকির অভিযোগ ছিল। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা দেশের বিচার বিভাগে নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড কেবল একটি পারিবারিক ট্র্যাজেডি নয়, বরং বিচারক ও তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তা এবং আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।

সুপ্রিম কোর্ট পুরো ঘটনাটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, প্রধান বিচারপতি শোক প্রকাশ করেছেন এবং আইন ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছেন।

ঘটনাটি কীভাবে ঘটল: মুহূর্তে রক্তাক্ত

বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর ২০২৫) বিকেল  আড়াইটা থেকে ৩টার মধ্যে রাজশাহী নগরের রাজপাড়া থানাধীন ডাবতলা এলাকার স্পার্ক ভিউ ভবনের তৃতীয় তলায় অবস্থিত বিচারকের ভাড়া বাসায় এই নৃশংস হামলা ঘটে।

একজন ৩৫ বছর বয়সী যুবক, যার নাম লিমন মিয়া (বাড়ি গাইবান্ধা জেলায়), ভবনের দারোয়ান মেসের আলীকে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে বলেন, “আমি বিচারকের ভাই।” দারোয়ানের খাতায় তিনি নাম লেখেন “লিমন” এবং দেন একটি মোবাইল নম্বর। দারোয়ান জানান, “আগে কখনও দেখিনি, তাই ঢুকতে দিয়েছি। দুপুর আড়াইটায় ফ্ল্যাটে গেলেন, প্রায় আধঘণ্টা পর চিৎকার শুনে দৌড়ে যাই।”

ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেই লিমন ধারালো অস্ত্র (ছুরি বা চাপাতি) দিয়ে অতর্কিত হামলা চালান। তাওসিফ রহমানকে একাধিকবার আঘাত করলে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। তাঁর মা তাসমিন নাহার লুসী হামলাকারীকে প্রতিরোধ করতে গেলে গুরুতরভাবে আহত হন। প্রতিরক্ষায় লড়াইয়ের সময় হামলাকারী নিজেও আহত হন। প্রতিবেশীরা চিৎকার শুনে পুলিশে খবর দেন। লিমন পালানোর চেষ্টা করলেও ধরা পড়েন।

তাওসিফের মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (রামেক) মর্গে পাঠানো হয়েছে। তাসমিন নাহারের অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে, তিনি এখন আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। লিমনও হাসপাতালে পুলিশ পাহারায় রয়েছেন। বিচারক মোহাম্মদ আব্দুর রহমান ঘটনাস্থলে ছিলেন না—তিনি সম্ভবত জামালপুরে গ্রামের বাড়িতে ছিলেন এবং খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন।

সিলেটের পুরনো জিডি ও হুমকির সূত্র

বিচারক মোহাম্মদ আব্দুর রহমান ২০২৫ সালের আগস্টে রাজশাহীতে দায়িত্ব নেন। এর আগে তিনি সিলেটের জালালাবাদ (সুরমা) থানায় কর্মরত ছিলেন।

৬ নভেম্বর ২০২৫-এ তাসমিন নাহার লুসী ওই থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন, যেখানে তিনি লিমন মিয়ার বিরুদ্ধে হত্যার হুমকি এবং নিরাপত্তাহীনতার কথা উল্লেখ করেন। জিডিতে লেখা ছিল—“কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সদস্য হওয়ার সুবাদে লিমন মিয়া পরিবারকে হুমকি দিচ্ছেন।”

পুলিশ এখন এই জিডিকে তদন্তের কেন্দ্রে রেখেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এটি একটি পুরনো পারিবারিক বা ব্যক্তিগত বিরোধের পরিণতি। লিমনের পকেট থেকে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া গেছে, যা দেখে অনুমান করা হচ্ছে তিনি পেশায় একজন ড্রাইভার। তাঁর মোবাইল নম্বরও উদ্ধার হয়েছে এবং তা ট্র্যাক করা হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক বা বিচারকের পেশাগত কাজের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ।

তদন্তের অগ্রগতি: পুলিশের তৎপরতা ও অমীমাংসিত প্রশ্ন

রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান ঘটনাস্থল ও হাসপাতাল পরিদর্শন করে জানান, “পারিবারিক শত্রুতা প্রধান সন্দেহ, তবে স্পষ্ট উদ্দেশ্য জানতে জেরা চলছে। তদন্তে কোনো ত্রুটি সহ্য করা হবে না।”

উপ-পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) গাজিউর রহমান বলেন, “আটক লিমনকে জেরা করা হচ্ছে। তাঁর কাছ থেকে প্রাথমিক তথ্য নেওয়া হয়েছে, শিগগিরই আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসবে।”

পুলিশের সর্বশেষ ব্যবস্থা

লিমনকে রামেক হাসপাতালে পুলিশ পাহারায় জেরা করা হচ্ছে। ক্রাইম সিন ইউনিট ও ফরেনসিক টিম ঘটনাস্থল থেকে অস্ত্র উদ্ধার করেছে। রাজপাড়া থানায় মামলা দায়ের হয়েছে।

সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ চলছে। গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং সাইবার ইউনিট তদন্তে যুক্ত হয়েছে।

সিলেট থেকে জিডির পূর্ণ কপি সংগ্রহ চলছে।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে তদন্তের ওপর কেন্দ্রীয় নজরদারি অব্যাহত আছে।

প্রধান বিচারপতি মন্তব্য করেছেন, “এমন ঘটনা বিচার ব্যবস্থাকে দুর্বল করে। সর্বোচ্চ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।”

তবে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত—
হামলাকারী কীভাবে এত সহজে ভবনে প্রবেশ করল? বিচারকের পরিবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কি ঘাটতি ছিল? এই ঘটনা কি কেবল পারিবারিক প্রতিশোধ, নাকি আরও গভীর কোনো উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে?

পুলিশ জানিয়েছে, এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফরেনসিক ও সাইবার টিম যৌথভাবে কাজ করছে।

সামাজিক প্রতিক্রিয়া: শোক, ক্ষোভ ও নিরাপত্তার দাবি

রাজশাহীজুড়ে শোকের ছায়া নেমেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা বিচারকের বাসার সামনে মোমবাতি জ্বেলে শোক প্রকাশ করেছেন এবং বিচারক পরিবারের নিরাপত্তা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন।

সামাজিক মাধ্যমে, বিশেষ করে এক্স (পূর্বে টুইটার)-এ ঘটনাটি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। “ন্যায়বিচার চাই” হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করছে। আইনজীবী ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা বিচারকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে বিবৃতি দিচ্ছেন।

স্থানীয় সাংবাদিক মোহাম্মদ আলী বলেন, “এটি যদি পারিবারিক বিরোধও হয়, তবুও বিচারকের পরিবারের নিরাপত্তা ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয়। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।”

সুপ্রিম কোর্টের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই ঘটনা “বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার নিরাপত্তা কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।”

ন্যায়বিচারের প্রতীক্ষায় এক বিধ্বস্ত পরিবার

রাজশাহীর এই হত্যাকাণ্ড কেবল একটি পরিবারের জন্য নয়, দেশের বিচার প্রশাসনের জন্যও একটি বড় আঘাত। তাওসিফ রহমানের মৃত্যু ও তাসমিন নাহারের যন্ত্রণা আজ সারাদেশকে নাড়া দিয়েছে।

পুলিশের তদন্ত চলছে, কিন্তু জনগণের চোখ এখন ন্যায়বিচারের দিকে। লিমনের জবানবন্দি ও পোস্টমর্টেম রিপোর্ট তদন্তে নতুন মোড় আনতে পারে।

“এমন মর্মান্তিক ঘটনা আর না ঘটুক”—এই প্রত্যাশা ও প্রার্থনাই এখন সবার।