জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট-নির্বাচন একই দিনে

জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নের পথে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ: প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে গণভোট ও নির্বাচন একই দিনে, রাজনৈতিক ঐক্যের আহ্বান
টুইট প্রতিবেদক: বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আজ জাতির উদ্দেশে এক ঐতিহাসিক ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫-এর বাস্তবায়ন আদেশের ঘোষণা দিয়েছেন।
এই আদেশে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের স্বাক্ষর সহ গণভোটের পথ উন্মোচিত হয়েছে, যা আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাথে একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে। ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মৃতিকে সম্মান জানিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন, বলেছেন, “এই ঐক্য না থাকলে জাতি মহাবিপদের সম্মুখীন হবে।”
এই ঘোষণা দেশের রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে, যা সংবিধান সংস্কারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মজবুত ভিত্তি স্থাপনের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ।
ভাষণের ও প্রেক্ষাপট
আজ বিকেল ২:৩০ মিনিটে বাংলাদেশ টেলিভিশন, বিটিভি নিউজ এবং বাংলাদেশ বেতারের মাধ্যমে সম্প্রচারিত এই ভাষণটি উপদেষ্টা মণ্ডলীর সভায় ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫’ অনুমোদনের পরই হস্তগত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির দপ্তর থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, রাষ্ট্রপতি এই আদেশে স্বাক্ষর করেছেন, এবং এটি শীঘ্রই গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে প্রকাশিত হবে।
এই আদেশটি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রণীত জুলাই সনদকে মূল দলিল হিসেবে গ্রহণ করে সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু করে, যাতে ৩০টি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য তৈরি হয়েছে।
পটভূমি হিসেবে, ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের ফলে পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকারের তিনটি মূল দায়িত্ব ছিল: হত্যাকাণ্ডের বিচার, সংস্কারের আয়োজন এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর। গত ১৫ মাসে এই লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল প্রথম রায় জারি করতে যাচ্ছে, গুমের বিচার শুরু হয়েছে এবং বিচার বিভাগ, আর্থিক খাত, ডিজিটালাইজেশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার সম্পন্ন হয়েছে।
ভাষণের হাইলাইটস : হুবহু উদ্ধৃতি সহ বিস্তারিত বিবরণ
প্রধান উপদেষ্টা ভাষণ শুরু করেন ইসলামী স্লোগান ‘বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম’ দিয়ে এবং সকল শ্রেণিবর্গকে সালাম জানিয়ে। তিনি বলেন, “আসসালামু আলাইকুম। গত বছর আগস্ট মাসে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিবলে আমরা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছিলাম। এরপর আমরা এখন আমাদের মেয়াদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে উপনীত হয়েছি।”
হত্যাকাণ্ডের বিচার: “আমরা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে তৎকালীন ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্দেশে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের বিচারকাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এই বিচারের উদ্দেশ্যে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের প্রথম রায় শীঘ্রই দিতে যাচ্ছে। ট্রাইব্যুনালে আরও কয়েকটি মামলার বিচার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সাধারণ ফৌজদারি আদালতগুলোতেও জুলাই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কিত কিছু বিচারকাজ শুরু হয়েছে। আমরা একইসাথে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গুমের মতো নৃশংস অপরাধের বিচারকাজ শুরু করেছি।”
সংস্কারের অগ্রগতি: “আমি আনন্দের সঙ্গে আপনাদের জানাতে চাই যে সংস্কারের ক্ষেত্রেও আমরা ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছি। অন্তর্বর্তী সরকার নিজ উদ্যোগে বা বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করেছে। … ভবিষ্যতে সুশাসনের জন্য এসব সংস্কার বড় ভূমিকা রাখবে বলে আমরা মনে করি। আশা করি, আগামী নির্বাচিত সরকার সংসদে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এসব সংস্কার গ্রহণ করবে।”
নির্বাচনের ঘোষণা: “আমি ঘোষণা করেছি যে আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচন উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের জন্য আমরা সব প্রস্তুতি গ্রহণ করছি।”
জুলাই সনদের ঐকমত্য প্রক্রিয়া: “রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের প্রস্তাব তৈরির লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন নিরলসভাবে গত প্রায় নয় মাস ধরে কাজ করেছে। … এটি বাংলাদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে তো বটেই, পৃথিবীর অনেক দেশের জন্য এক অভূতপূর্ব ঘটনা।” তিনি কমিশনের সদস্য ও রাজনৈতিক দলগুলোকে ধন্যবাদ জানান।
বাস্তবায়ন আদেশের ঘোষণা: “এসব বিবেচনায় রেখে … অন্তর্বর্তী সরকার আজকের উপদেষ্টামণ্ডলীর সভায় জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ অনুমোদন করেছে। এটি বিরাট খবর। … জুলাই সনদ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই আদেশে আমরা গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিধান গ্রহণ করেছি। এর মধ্যে রয়েছে সনদের সংবিধান বিষয়ক সংস্কার প্রস্তাবণার ওপর গণভোট অনুষ্ঠান এবং পরবর্তী সময়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত।”
গণভোটের বিবরণ: প্রধান উপদেষ্টা গণভোটের প্রশ্নটি হুবহু পাঠ করে শোনান: “আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং জুলাই জাতীয় সনদে লিপিবদ্ধ সংবিধান সংস্কার সম্পর্কিত নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলোর প্রতি আপনার সম্মতি জ্ঞাপন করছেন?”
ক) নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
খ) আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধন করতে হলে উচ্চকক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের অনুমোদন দরকার হবে।
গ) সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার ও সংসদীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও স্থানীয় সরকারসহ ৩০টি প্রস্তাবে ঐক্যমতের বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক।
ঘ) জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।
“গণভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট ‘হ্যাঁ’ সূচক হলে আগামী সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে একটি সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠিত হবে। এই প্রতিনিধিগণ একইসাথে জাতীয় সংসদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পরিষদ তার প্রথম অধিবেশন শুরুর তারিখ হতে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে।”
তিনি আরও বলেন, জুলাই সনদ সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অর্থনৈতিক অগ্রগতি: “অভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব গ্রহণ করে অর্থনীতিকে গভীর গহ্বর থেকে উদ্ধার করা ছিল আমাদের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ। গত ১৫ মাসে আমরা সেই চ্যালেঞ্জ উত্রাতে সক্ষম হয়েছি। রপ্তানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ ও রিজার্ভসহ অর্থনীতির সবগুলো সূচকে দেশ ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে। … বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রথম বছরে বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ অর্থাৎ এফডিআই ১৯.১৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।” তিনি লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পে ডেনমার্কের মায়ার্স্ক গ্রুপের ৫৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের খবরও শেয়ার করেন, যা দেশের প্রথম ‘গ্রিন পোর্ট’ হিসেবে গড়ে উঠবে।
ঐক্যের আহ্বান: ভাষণের শেষভাগে তিনি বলেন, “প্রিয় দেশবাসী, প্রায় দেড় যুগ ধরে আমাদের জনগণ ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তাঁরা আজ আসন্ন নির্বাচনে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। আগামী ফেব্রুয়ারিতে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে অভ্যুত্থানের স্বপক্ষের রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। … ১৩৩ শিশু, শত শত তরুণ-তরুণী, নারী-পুরুষের মৃত্যু, হাজার হাজার মানুষের অঙ্গহানির যে আত্মত্যাগ সেটিকে আমাদের সম্মান জানাতেই হবে। … আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছালাম। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আল্লাহ হাফেজ। সবাইকে ধন্যবাদ।”
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া ও সমালোচনা
ভাষণের পর রাজনৈতিক দলগুলোর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম বলেছেন, “আগামী নির্বাচনে জুলাই বিপ্লবের পক্ষের ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী শক্তির বিজয় হবে।” তবে তারা গণভোটের তারিখ ঘোষণার দাবি পুনর্ব্যক্ত করেছেন।
বিএনপির অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন দল গণভোটকে “পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার তৈরির চেয়ে কম জরুরি” বলে সমালোচনা করেছেন, যদিও তারা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, “জুলাই সনদের পথে আমরা রয়েছি, এটি বাস্তবায়িত হবেই।”
সামাজিক মাধ্যমে (X-এ) ভাষণ নিয়ে তীব্র আলোচনা চলছে। অনেকে এটিকে “ঐতিহাসিক” বলে অভিহিত করেছেন, যখন কেউ কেউ গণভোটের সময়সীমা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। গত সপ্তাহে ১১ নভেম্বর পল্টন মোড়ে ৮ দলের সমাবেশে ৫-দফা দাবি উত্থাপিত হয়েছে, যার মধ্যে গণভোটের অগ্রাধিকার ছিল।
ভবিষ্যত প্রভাব ও চ্যালেঞ্জ
এই আদেশের ফলে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন হলে ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে সংশোধন সম্পন্ন হবে, এবং উচ্চকক্ষ গঠনের মাধ্যমে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের যুগ শুরু হবে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটি ফ্যাসিবাদের পুনরাবৃত্তি রোধে সুরক্ষা প্রদান করবে, তবে রাজনৈতিক ঐক্যের অভাবে নির্বাচন জটিল হতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণটি লাইভ স্ট্রিমিংয়ে লক্ষ লক্ষ দর্শক দেখেছেন, এবং এটি নতুন বাংলাদেশ গঠনের প্রতীক হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।






