পাহাড়ে ৬ এতিম শিশুর হাসি ফুটিয়ে জীবন বদলে দিল সেনাবাহিনী

টুইট প্রতিবেদক: বান্দরবানের গভীর পাহাড়ে—ঝিরি, ঝর্ণা আর কুয়াশার মাঝে—একটি ছোট্ট পাড়া, নাম লাইমি পাড়া, রোয়াংছড়ি। এখানেই বাস করে বম সম্প্রদায়ের ছয়টি শিশু, যারা হারিয়েছে তাদের মা-বাবাকে। রাতের আঁধারে বাবা-মাকে হারিয়ে এই শিশুরা বড় হয়েছে দাদি-নানির কোলে, কখনো না খেয়ে, কখনো জুতা ছাড়া হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে গিয়ে।

কিন্তু আজ তাদের জীবনে এসেছে নতুন আলো, নতুন আশার সূর্য। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বান্দরবান রিজিয়ন ঘোষণা করেছে—এই ছয় এতিম শিশুর পুরো এক বছরের লেখাপড়া, খাওয়া-পরা ও চিকিৎসার দায়িত্ব এখন সেনাবাহিনীর হাতে।

এই ছয় শিশু হলো—রিংকু বম (৯), সোনালী বম (৭), থুই মং বম (১১), চাই প্রু বম (৮), মেনু বম (১০) ও লাল মনি বম (৬)। তারা বর্তমানে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে। রিংকুর স্বপ্ন পাইলট হওয়া, সোনালী গায়ক হতে চায়, থুই মং ফুটবলার, চাই প্রু চিত্রশিল্পী, মেনু ডাক্তার আর ছোট্ট লাল মনি চায় ‘সেনা স্যার’ হতে।

তাদের জীবনের পেছনে রয়েছে করুণ ইতিহাস। রিংকু ও সোনালীর বাবা ২০২৩ সালে কেএনএফ-সেনা গুলিতে নিহত হন। থুই মংয়ের মা-বাবা ২০২৪ সালে ব্যাংক লুটের ঘটনায় ‘ক্রসফায়ারে’ নিখোঁজ হন। চাই প্রু ও মেনুর বাবা-মা টিবি রোগে মারা যান, কারণ ওষুধ কেনার টাকা ছিল না। আর লাল মনি জন্মের তিন মাসের মাথায় মা’কে হারায়, এরপর বাবা পাহাড়ে হারিয়ে যান।

লাইমি পাড়ার হেডম্যান ক্য শৈ প্রু বলেন, “এক বছরে আমাদের পাড়ায় ১২ জন মারা গেছে। শিশুরা রাতে কাঁদে, দিনে খাবার খোঁজে। সেনাবাহিনীর সহায়তা তাদের নতুন জীবন দিয়েছে।”

বান্দরবান রিজিয়ন কর্তৃপক্ষ এই শিশুদের জন্য এক বছরের পূর্ণ সহায়তা ঘোষণা করেছে। এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে শিক্ষা উপকরণ, স্কুল ফি, ব্যাগ, ড্রেস, বই-খাতা, মাসিক খাদ্য সামগ্রী হিসেবে ১৫ কেজি চাল-ডাল-তেল, নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা ও ফ্রি ওষুধ। এছাড়া প্রতি মাসে একদিন ‘সেনা আঙ্কল ডে’ নির্ধারিত হয়েছে, যেদিন সেনা সদস্যরা শিশুদের সঙ্গে গল্প, খেলা ও পড়াশোনায় সময় কাটাবেন।

মেজর পারভেজ রহমান (জিএসও-২, বান্দরবান রিজিয়ন) বলেন, “আমরা শুধু সীমান্ত পাহারা দিই না—স্বপ্ন পাহারা দিই। এরা আমাদের সন্তান।”

একই দিনে সেনাবাহিনী আরও কয়েকটি মানবিক সহায়তা কার্যক্রমও সম্পন্ন করেছে। গৃহহীন পাঁচ পরিবারকে দেওয়া হয়েছে ঢেউটিন, অসহায় পাঁচ নারীকে সেলাই মেশিন, লাইমি পাড়া সমবায় সমিতিকে দেওয়া হয়েছে ৫০টি প্লাস্টিক চেয়ার, আর চারটি দুঃস্থ পরিবারকে দেওয়া হয়েছে ২৫,০০০ টাকা করে নগদ সহায়তা।

১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তির পর থেকে সেনাবাহিনী পাহাড়ে শুধু শান্তি নয়, উন্নয়ন ও মানবিক কার্যক্রমেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ৫০০টির বেশি ক্যাম্পের মধ্যে ৪৬৫টি ক্যাম্প অপসারণের পরও তারা স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও উন্নয়নে পাশে রয়েছে। ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ লাখ মানুষকে ফ্রি চিকিৎসা দিয়েছে সেনাবাহিনী। বর্তমানে পাহাড়ে তাদের ৬৮টি স্কুল, ১২টি এতিমখানা ও অসংখ্য কমিউনিটি প্রকল্প পরিচালিত হচ্ছে।

রিজিয়ন কমান্ডার বলেন, “আমরা পাহাড়ে শুধু শান্তি নয়—শান্তি, সমৃদ্ধি ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা করতে চাই।”

শুক্রবার সকালে বান্দরবান সেনানিবাসে শিশুদের হাতে নতুন বই ও ব্যাগ তুলে দেওয়া হয়। তখন মুখে ফুটে ওঠে তাদের প্রথম হাসি। রিংকু উচ্ছ্বাসে বলে, “স্যার, আমি পাইলট হব!” সোনালী গেয়ে ওঠে, “আমার ভাইয়া সেনা ভাইয়া…” আর ছোট্ট লাল মনি ব্যাগ বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

লাল মনির দাদি লালথুয়াইতেলং চোখ মুছতে মুছতে বলেন, “নাতির চোখে আলো ফিরেছে। সেনা ভাইয়ারা আমাদের আপনজন।”

২০২৬ সালের শুরুতেই এই শিশুদের হোস্টেলে ভর্তি করা হবে। লক্ষ্য—তাদের অন্তত দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা নিশ্চিত করা। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে দীর্ঘমেয়াদি সহায়তার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে।

যেখানে একসময় গুলির শব্দে পাহাড় কেঁপে উঠত, সেখানে এখন বইয়ের গন্ধ। যেখানে ছিল কান্না, সেখানে এখন শোনা যায় “সেনা ভাইয়া”র ডাক। ছয়টি শিশুর হাসি যেন আজ ১৮ কোটি বাংলাদেশির গর্বের প্রতিচ্ছবি।

“সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা—সর্বত্র আমরা দেশের তরে।”
—বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

এ পাহাড়-সমতলের একতার প্রতীক, বাংলাদেশের গর্ব।