পাহাড়ে ‘সাধু সাধু’ ধ্বনিতে মুখরিত হলো রাজগুরু বৌদ্ধ বিহার

বান্দরবানে উদযাপিত হলো বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মহাপিন্ডদান উৎসব-২০২৫: শান্তি ও পুণ্যের অপূর্ব আঙ্গিক
অসীম রায় (অশ্বিনী). বান্দরবান: পাহাড়ি জেলা বান্দরবানের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে এবছরও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মহাপিন্ডদান উৎসব অত্যন্ত উল্লাসময় ও ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। আশ্বিনী পূর্ণিমা উপলক্ষে ৫ নভেম্বর বুধবার দিনভর চলা এই অনুষ্ঠানে হাজার হাজার দায়ক-দায়িকার অংশগ্রহণ ঘটেছে।
মাসব্যাপী কঠিন চীবরদান উৎসবের সমাপ্তি হিসেবে এই মহাপিন্ডদান শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠানই নয়, বরং সমাজের সকল স্তরের মানুষের মিলিত উদ্যোগের এক প্রতীক হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন বিহারে অনুষ্ঠিত এই উৎসবে প্রায় ৪০০-এর বেশি বৌদ্ধ ভিক্ষু অংশ নিয়েছেন, যা স্থানীয় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের অটুট ঐক্যের প্রমাণ বহন করে।
বৌদ্ধ ধর্মের বর্ষাকালীন বর্ষাবাসের পরিপূর্ণতা হিসেবে আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাস ধরে চলা বর্ষাবাসের সমাপ্তি ঘটে কঠিন চীবরদান উৎসবের মাধ্যমে। এরপর মাসব্যাপী চীবরদানের সময়কালে ভিক্ষু সংঘকে বিভিন্ন ধরনের দান-সামগ্রী প্রদান করা হয়, যা ধর্মীয় শৃঙ্খলা ও পুণ্যার্জনের প্রতীক। শেষ পর্যায়ে মহাপিন্ডদান উৎসবের মাধ্যমে ভিক্ষুদের প্রতি সম্মান জানানো হয় রান্না করা খাবার (পিন্ড) বিতরণের মাধ্যমে।
এই উৎসবটি শুধু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের জন্য নয়, বরং পুরো দেশের সকলের শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রার্থনা বহন করে। বান্দরবানের মতো পাহাড়ি অঞ্চলে এই অনুষ্ঠানগুলো স্থানীয় সংস্কৃতির অঙ্গীভূত অংশ, যা বছরের পর বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে।
প্রথম পর্ব থেকে মহাপিন্ডদান
উৎসবের প্রথম পর্ব সকাল ৫টায় শুরু হয়েছে বিশ্বশান্তি কামনায় বুদ্ধ বন্দনা ও পূজনীয় ভিক্ষু সংঘের প্রাতঃরাশ দিয়ে। এরপর জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানকে আরও গাম্ভীর্যপূর্ণ করা হয়। সকাল ৮টার দিকে মূল অনুষ্ঠানের সূচনা হয় বান্দরবান রাজগুরু বৌদ্ধ বিহার থেকে। এখান থেকে প্রায় ৩০০-এরও বেশি বৌদ্ধ ভিক্ষু নিয়ে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি বের হয়েছে, যা বান্দরবান সদরের প্রধান সড়কগুলো প্রদক্ষীণ করে। 
র্যালি শেষ হওয়ার সাথে সাথে ভিক্ষুসংঘ পিন্ড গ্রহণ শুরু করেন। এ সময় ভক্তরা তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে নগদ অর্থ, চাল, ফলমূল, মিষ্টান্ন, মোমবাতি, আগরবাতি এবং অন্যান্য উপকরণ দান করেন। বিভিন্ন বৌদ্ধ বিহারে কঠিন চীবরদানের পর ভিক্ষুদের সম্মানে পিন্ড বিতরণ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে, যেখানে শত শত শিশু, কিশোর-কিশোরী এবং নারী-পুরুষ পুণ্যার্জনের আশায় অংশ নিয়েছেন। এই দানের মাধ্যমে সকলে দেশের সকলের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রার্থনা করেছেন।
বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ
অনুষ্ঠানে পার্বত্য চট্টগ্রামের সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল। বোমাং রাজা উচ প্রু, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য কেএসমং, রাজগুরু বৌদ্ধ বিহার পরিচালনা কমিটির সভাপতি রাজকুমার মং ওয়ে প্রু এবং সিনিয়র সহ-সভাপতি মং ক্য শোয়েনু নেভীসহ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিভিন্ন স্তরের নারী-পুরুষ অংশগ্রহণ করেন। তারা নিজেরাই ভিক্ষু সংঘকে পিন্ডদান করে অনুষ্ঠানকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এই উপস্থিতি উৎসবকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে, যা স্থানীয় সম্প্রদায়ের ঐক্যের প্রতীক।
স্থানীয় প্রভাব ও ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা
বান্দরবানের এই মহাপিন্ডদান উৎসব শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং সামাজিক সংহতির এক মহান উদাহরণ। হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণ সত্ত্বেও অনুষ্ঠান শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে, যা পাহাড়ি অঞ্চলের স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়। স্থানীয় বাসিন্দারা এই উৎসবকে পুণ্যের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক উৎসব হিসেবে উদযাপন করেন, যা পর্যটনের দিক থেকেও আকর্ষণীয়।
আগামী বছরও এই ঐতিহ্য অব্যাহত থাকবে বলে স্থানীয় নেতারা আশা প্রকাশ করেছেন।










