মামদানির মেয়র জয়ের পেছনে ‘নীরব স্থপতি’ রামা দুয়াজি

সিরামিক যিনি নিউ ইয়র্কের দেয়ালে সিরিয়ার স্মৃতি আঁকেন।

টুইট প্রতিবেদক: নিউ ইয়র্ক সিটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট মেয়র হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন জোরান খালিদ মামদানি। ৩৪ বছর বয়সী এই তরুণ রাজনীতিক গতকালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রাইমারি ও সাধারণ নির্বাচন উভয় ক্ষেত্রেই বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে নিউ ইয়র্কের ১১১তম মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন।

তবে এই ঐতিহাসিক জয়ের পেছনে যে নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে, তা হলো ”রামা দুয়াজি”—মামদানির স্ত্রী এবং প্রচারণার ‘নীরব স্থপতি’।

“কোন কালে একা হয়নিতো জয়ী পুরুষের তরবারি।”

প্রচারণার নকশাকার, মঞ্চে না থাকা শিল্পী

জোরান মামদানির নির্বাচনী প্রচারণা যেমন ভিজ্যুয়ালি আকর্ষণীয়, ডিজিটালি শক্তিশালী এবং নীতিগতভাবে স্পষ্ট, তা দেখে অনেকেই মনে করেছিলেন যে এর পেছনে একটি পেশাদার টিম কাজ করছে। তবে শিবিরের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানিয়েছে, এই পুরো কাঠামোর মূল নকশাকার ছিলেন রামা দুয়াজি।

লোগো, পোস্টার, স্লোগান, ওয়েবসাইটের ডিজাইন—সবই তার হাতে তৈরি।

শক্তিশালী বার্তাগুলো যেমন ‘Housing for All’ এবং ‘Community First’ তার দৃষ্টিভঙ্গির অংশ।

প্রচারণার সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট—ইনস্টাগ্রাম রিল, টিকটক ভিডিও ও টুইটার থ্রেড—তার নান্দনিক নির্দেশনায় ভাইরাল হয়েছে।

স্বেচ্ছাসেবকরা জানান, “আমরা যখন কোনো পোস্টার বা ভিডিও তৈরি করতাম, রামা একবার দেখলেই বলে দিতেন—‘এটা মানুষের মনে ঢুকবে না। এটা বদলাও।’ আর সত্যিই, তার বদলানো ডিজাইনগুলোই ভাইরাল হয়েছে।”

রামা দুয়াজি জন্মগ্রহণ করেছেন সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে। শৈশবের কিছু বছর তিনি দুবাইয়ে কাটান এবং পরে পরিবারসহ স্থায়ীভাবে নিউ ইয়র্কে বসবাস শুরু করেন। পেশায় তিনি একজন সিরামিক শিল্পী ও ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট, যিনি শিল্পী মনন দিয়ে কাজ করেন এবং তার দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিটি কাজকে অনন্য করে তোলে। তার শিল্পকর্ম বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রকাশনায় উল্লেখিত হয়েছে, যেমন The New Yorker, The Washington Post, Vogue এবং Hyperallergic।

এছাড়াও তার প্রদর্শনী আয়োজন হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক স্থানগুলোতে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন মিউজিয়াম এবং লন্ডনের Tate Modern Satellite। রামা শিক্ষা গ্রহণ করেছেন Pratt Institute, নিউ ইয়র্ক থেকে Fine Arts-এ, যা তার শিল্পজীবনের ভিত্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

রামা কখনো রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়াননি, কোনো সাক্ষাৎকার দেননি এবং সামাজিক মাধ্যমে তার কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। তার একমাত্র পরিচয়—শিল্পী। তবে তার শিল্পী মনেই মামদানির প্রচারণাকে দিয়েছে অদ্বিতীয় নান্দনিকতা ও গভীরতা।

নীতিগত প্রভাবও প্রমাণিত-শুধু ডিজাইন নয়, নীতিগত স্তরেও রামার প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

হাউজিং নীতি: মামদানির ‘Housing for All’ প্রোগ্রামে কমিউনিটি-ভিত্তিক আবাসন মডেল রামার পরামর্শে যুক্ত হয়। তিনি বলেন, “আবাসন শুধু ইট-সিমেন্ট নয়, এটা মানুষের স্মৃতি, সংস্কৃতি ও সম্পর্কের জায়গা।”

কমিউনিটি স্পেস: পার্ক, লাইব্রেরি ও কমিউনিটি সেন্টারের নকশায় শিল্প ও সংস্কৃতির সংমিশ্রণ তার ধারণা।
ইকুইটি ফোকাস: প্রচারণায় ‘Equity over Equality’স্লোগানটি তারই দেওয়া।

বিবাহ ও ব্যক্তিগত জীবন

২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ব্রুকলিনের একটি ছোট গ্যালারিতে মাত্র ১৫ জন অতিথির উপস্থিতিতে রামা ও জোরান বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। কোনো মিডিয়া উপস্থিত ছিল না এবং বিয়ের ছবি প্রকাশিত হয়নি।

সূত্র জানায়, রামা চাননি তার ব্যক্তিগত জীবন রাজনীতির অংশ হোক। তিনি বলেছিলেন, “আমি যা করি, তা জোরানের কাজকে শক্তিশালী করার জন্য। আমার নামের জন্য নয়।”

নির্বাচনের পর প্রতিক্রিয়া

জয়ের পর মামদানি বলেন, “আমার পাশে যিনি দাঁড়িয়েছেন, যিনি আমার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পোস্টার, প্রতিটি স্বপ্নকে সুন্দর করে তুলেছেন—তাকে আমি ধন্যবাদ জানাই। তিনি আমার সবচেয়ে বড় সমালোচক, সবচেয়ে বড় সমর্থক।”

যদিও তিনি নাম উল্লেখ করেননি, সবাই জানে কথাটি রামা দুয়াজির জন্য।

ভবিষ্যৎ প্রশ্ন?

মেয়র হিসেবে মামদানি যখন সিটি হলে প্রবেশ করবেন, রামা কি তখনো পর্দার আড়ালে থাকবেন? নাকি তার শিল্প ও নীতির সমন্বয় নিউ ইয়র্কের প্রশাসনে নতুন মাত্রা যোগ করবে?

একজন স্বেচ্ছাসেবক বলেন, “রামা যদি চান, তিনি পুরো সিটিকে একটা জীবন্ত শিল্পকর্মে পরিণত করতে পারেন। কিন্তু তিনি চাইবেন না। তিনি শুধু চাইবেন—কাজটা যেন ঠিক হয়।”

নিউ ইয়র্কবাসী এখন দেখবে, শহরের নতুন মেয়রের কাঁধে যে নীরব শিল্পীর অবদান লুকানো ছিল, তা কীভাবে শহরের চেহারা ও নীতি পরিবর্তন করবে।