দুবলারচরে পুণ্যস্নানে সমাপ্তি: রাস উৎসব

ন্দরবনের কোলে আলোরকোলে পুণ্যস্নানে মুখরিত দুবলারচর; ১৩,৫১৯ ভক্তের মিলনে শান্তিপূর্ণ রাস উৎসব সমাপ্ত।
টুইট প্রতিবেদক: সুন্দরবনের গভীরে, বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত দুবলারচরের আলোরকোল। এই দুর্গম দ্বীপে শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বুধবার (৫ নভেম্বর ২০২৫) প্রত্যুষে প্রথম জোয়ারের নোনা জলে পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত হলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তিন দিনব্যাপী রাস উৎসব।
গত ৩ নভেম্বর সোমবার থেকে শুরু হওয়া এই ধর্মীয় মহোৎসবে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মোট ১৩,৫১৯ জন পুণ্যার্থী অংশগ্রহণ করেন। এ সংখ্যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। পুণ্যার্থীদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশের খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার ভক্ত। এছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম এবং নেপাল, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী প্রবাসী বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ও যোগ দেন।
অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগই নৌপথে খেপুপাড়া, শরণখোলা ও মংলা বন্দর হয়ে দুবলারচরে পৌঁছান। মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দিবাগত রাতে আলোরকোলের বালুকাবেলায় স্থাপিত অস্থায়ী রাধাকৃষ্ণ মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় মহাপূজা ও অর্চনা, রাসলীলা নাট্য প্রদর্শন, ভজন-কীর্তন ও মহাপ্রসাদ বিতরণ। রাত ২টা থেকে ভোর ৪টা পর্যন্ত চলে অবিরাম কীর্তন। স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে যোগ দেন কলকাতা ও আগরতলা থেকে আগত ভজনদল।
বুধবার ভোর ৪:৩০ মিনিটে প্রথম জোয়ার আসার সঙ্গে সঙ্গে পুণ্যার্থীরা সারিবদ্ধভাবে সমুদ্রে নামেন। শাঁখধ্বনি, উলুধ্বনি ও “জয় রাধে-কৃষ্ণ!” ধ্বনিতে মুখরিত হয় পুরো উপকূল। স্নান শেষে মন্দিরে চূড়ান্ত প্রসাদ গ্রহণ করে নিজ নিজ গন্তব্যে রওনা দেন ভক্তরা।
দুবলা আলোরকোল রাস উৎসব উদযাপন পরিষদের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, এই উৎসবের ইতিহাস শতাব্দীপ্রাচীন। ব্রিটিশ আমল থেকেই মৎস্যজীবী ও বনকর্মীরা কার্তিক মাসের পূর্ণিমায় এখানে রাধাকৃষ্ণের রাসলীলা উদযাপন করে আসছেন। স্বাধীনতার পর থেকে এটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর বিদেশি পর্যটক ও গবেষকরাও এই অনন্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য দেখতে আসেন।
পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) রানা দেব জানান, এবারের উৎসব সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ও আনন্দমুখর পরিবেশে সম্পন্ন হয়েছে। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। নিরাপত্তায় নিয়োজিত ছিলেন বন বিভাগের ৪৫ জন কর্মী, কোস্টগার্ডের ২টি স্পিডবোট ও ৩০ জন সদস্য, পুলিশের ২০ জন, নৌপুলিশের ১৫ জন এবং ফায়ার সার্ভিসের ১টি ইউনিট।
এছাড়া স্বাস্থ্যসেবার জন্য উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে ২টি মেডিকেল টিম, অ্যাম্বুলেন্স নৌকা ও প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। উৎসব চলাকালীন প্লাস্টিকমুক্ত পরিবেশ বজায় রাখতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়। পুণ্যার্থীদের জন্য বায়োডিগ্রেডেবল প্লেট ও গ্লাস ব্যবহার করা হয় এবং বর্জ্য সংগ্রহের জন্য ১৫টি ডাস্টবিন স্থাপন করা হয়। সুন্দরবনের বাঘ-হরিণ অভয়ারণ্যে শব্দদূষণ কমাতে মাইকের ভলিউম নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
স্থানীয় মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীরা জানান, উৎসবের কারণে তিন দিনে প্রায় ২ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। বিক্রি হয়েছে শুঁটকি, মধু, খেজুরের গুড়, হস্তশিল্প, পূজার সামগ্রী এবং নৌকা ভাড়া, খাবার-দাবার।
সকাল ৯টার মধ্যে অস্থায়ী মন্দির ভেঙে ফেলা হয়। মূল মূর্তি নিরাপদে খুলনার একটি মন্দিরে স্থানান্তর করা হয়। রানা দেব বলেন, আগামী বছর আরও সুষ্ঠু ও বৃহৎ পরিসরে উৎসব আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে।
দুবলারচরের রাস উৎসব কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়—এটি বাংলার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জীবন্ত প্রতীক। যেখানে সমুদ্র, সুন্দরবন ও মানুষের ভক্তি একাকার হয়ে ওঠে। আগামী কার্তিক পূর্ণিমায় আবারও বাজবে বাঁশি, ঢাকবে ঢাক, আর আলোরকোল হাসবে রাধাকৃষ্ণের রাসমঞ্চে। জয় রাধে-কৃষ্ণ!






