একীভূত প্রক্রিয়ায় থাকা ৫ ব্যাংকের পর্ষদ বিলুপ্ত

বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্ত এবং সর্বশেষ অগ্রগতি।
বদিউল আলম লিংকন: বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক সমস্যাগ্রস্ত পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংককে একীভূত করে একটি নতুন বৃহৎ ইসলামী ব্যাংক গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই পাঁচ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদগুলোকে বিলুপ্ত করে প্রশাসক নিয়োগের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
ব্যাংক খাতে সুশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নেওয়া একটি কঠোর ব্যবস্থা।
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ ৯ অক্টোবর, ২০২৫ তারিখে এই একীভূতকরণের প্রস্তাব অনুমোদন করে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘রেজল্যুশন পরিকল্পনা ২০২৫’ এর অংশ। এই প্রতিবেদনে ব্যাংকগুলোর বিস্তারিত তথ্য, প্রক্রিয়া, সর্বশেষ অগ্রগতি এবং প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হলো।
একীভূত হতে যাওয়া পাঁচটি ব্যাংক হলো
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক।
ইউনিয়ন ব্যাংক।
এক্সিম ব্যাংক।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক।
এই ব্যাংকগুলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত এবং শরিয়াহভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করে। গত বছর থেকে এগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংক ‘দুর্বল ব্যাংক’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এদের মূল সমস্যা হলো বিপুল মূলধন ঘাটতি, খেলাপি ঋণ (মন্দঋণ), প্রভিশন ঘাটতি এবং তারল্য সংকট।উ
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে প্রতিটি ব্যাংকের নেট অ্যাসেট ভ্যালু (NAV) ঋণাত্মক এবং শেয়ারের বাজারমূল্য অভিহিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম। এই ব্যাংকগুলোর মোট আমানতকারী প্রায় ৯০ লাখ এবং সম্পদের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। একীভূতকরণের মাধ্যমে এগুলোর সম্পদ ও দায়গুলো নতুন ব্যাংকে হস্তান্তরিত হবে, যার নাম প্রস্তাবিত ‘সম্মিলিত ইসলামী ব্যাংক’ বা ‘ইউনাইটেড ইসলামিক ব্যাংক’।
সিদ্ধান্ত এবং একীভূতকরণের প্রক্রিয়া
অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ (প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে) ৯ অক্টোবর, ২০২৫ তারিখে এই প্রস্তাব অনুমোদন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ১৬ সেপ্টেম্বর ‘রেজল্যুশন পরিকল্পনা ২০২৫’ অনুমোদন করে নতুন ব্যাংক গঠনের অনুমতি দেয়।
নতুন ব্যাংকের প্রাথমিক অনুমোদিত মূলধন ৪০ হাজার কোটি টাকা এবং পরিশোধিত মূলধন ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা প্রদান করবে (১০ হাজার কোটি নগদ এবং ১০ হাজার কোটি সুকুক বন্ডের মাধ্যমে)। বাকি ১৫ হাজার কোটি টাকা প্রাতিষ্ঠানিক আমানতকারীদের আমানতকে শেয়ারে রূপান্তর করে (বেইল-ইন প্রক্রিয়া) সংগ্রহ করা হবে, যা পরে রেজল্যুশন পরিকল্পনা অনুসারে পরিশোধ করা হবে।
পাঁচ ব্যাংকের সম্পূর্ণ সম্পদ, দায় এবং জনবল নতুন ব্যাংকে একীভূত হবে। নতুন ব্যাংক প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রমালিকানাধীন হবে এবং ৫ বছরের মধ্যে বেসরকারি খাতে হস্তান্তরিত হবে।
অর্থ বিভাগ নাম প্রস্তাব করবে, আরজেএসসি অনুমোদন দেবে, বিএসইসি থেকে অনুমতি নেয়া হবে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রজ্ঞাপন জারি হবে। অফিস রাজধানীর সেনা কল্যাণ ভবনে স্থাপিত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে সিমুলেশন অনুশীলন এবং ১০ বছরের আর্থিক-ব্যবসায়িক পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ৮ সেপ্টেম্বর একটি ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে।
পর্ষদ বিলুপ্তি এবং প্রশাসক নিয়োগ
প্রশাসক নিয়োগের আগে সকল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বিলুপ্ত (স্থগিত) করা হয়েছে এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (ইমডি) চুক্তি বাতিল করা হবে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের অধীনে নেওয়া ব্যবস্থা, যা একীভূতকরণ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার জন্য। প্রশাসকদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে এবং তারা ব্যাংকগুলোর তথ্য সংগ্রহ ও সমন্বয় করবেন।
এক্সিম ব্যাংক: শওকাতুল আলম (বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক)।
সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক: সালাহ উদ্দিন।
ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক: মুহাম্মদ বদিউজ্জামান দিদার।
গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক: মো. মোকসুদুজ্জামান
ইউনিয়ন ব্যাংক: মোহাম্মদ আবুল হাসেম
প্রশাসক নিয়োগের তারিখ: ৬ নভেম্বর, ২০২৫। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নোটিস প্রদান এবং যাচাই সম্পন্ন করেছে।
সর্বশেষ তথ্য অনুসারে (৫ নভেম্বর, ২০২৫ পর্যন্ত), প্রশাসক নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, যদিও আইনি জটিলতার কারণে সামান্য বিলম্ব হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফেরার পর বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে।
একইসঙ্গে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) একীভূতকরণের কর্মকৌশল, তহবিলের উৎস এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ব্যাংকগুলোতে আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, বিশেষ করে এক্সিম এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে, যারা একীভূতকরণের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ক্ষুদ্র আমানতকারীদের (২ লাখ টাকার কম) টাকা অগ্রাধিকারে ফেরত দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। সেনা কল্যাণ ভবনে সমন্বয় কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে।
প্রভাব এবং চ্যালেঞ্জ
ইতিবাচক প্রভাব: কোনো কর্মচারী চাকরি হারাবেন না এবং আমানতকারীরা আমানত হারাবেন না। ব্যাংক খাতে সামগ্রিক সংস্কার ঘটবে, মন্দঋণ সমাধান হবে এবং গ্রাহকদের আস্থা ফিরে আসবে। নতুন ব্যাংক বাণিজ্যিকভাবে পেশাদারির ভিত্তিতে চলবে।
চ্যালেঞ্জ: আমানতকারীদের অস্থিরতা, আইনি জটিলতা এবং সম্পদ যাচাইয়ে সময় লাগবে। আইএমএফ-এর প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এবং রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিত করা জরুরি। এক্সিম এবং সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের বিপক্ষতা প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলতে পারে।
এই একীভূতকরণ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করার একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ, যা সরকারের ২০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে। প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হলে গ্রাহকদের স্বার্থ সুরক্ষিত হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কতামূলক পদক্ষেপ এবং সরকারের সমর্থন এই সংস্কারকে সফল করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।






