৩৬ বছরেও নির্বাচন হয়নি পার্বত্য তিন জেলা পরিষদে

পার্বত্য তিন জেলার জেলা পরিষদে ৩৬ বছরেও নির্বাচন হয়নি – দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে জনগণ বঞ্চিতভ
অসীম রায় (অশ্বিনী): পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা—বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে জেলা পরিষদ নির্বাচন হয়নি। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে জেলা পরিষদগুলো পরিচালিত হচ্ছে অনির্বাচিত, সরকার দলীয় ব্যক্তিদের মাধ্যমে।
স্থানীয়রা বলছেন, জবাবদিহির অভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে গড়ে উঠেছে দুর্নীতির সংস্কৃতি, যার কারণে সুষম উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন পাহাড়ের লাখো মানুষ।
১৯৮৯ সালের নির্বাচন থেকে ৩৬ বছর
১৯৮৯ সালে পার্বত্য তিন জেলায় প্রথম ও শেষ জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে কোনো নির্বাচন হয়নি। এই সময়ে সরকার দলীয়ভাবে গঠিত ‘অন্তর্বর্তী পরিষদ’ দিয়েই জেলা প্রশাসন পরিচালিত হচ্ছে। প্রতিবছর শত কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদিত হয়, তবে অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগের কারণে জনঅসন্তোষ বাড়ছে।
ভোটে বাধা: জেএসএসের দাবি
তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ পরিচালিত হয় বিশেষ আইন অনুযায়ী, যা দেশের অন্য ৬১ জেলা পরিষদের নিয়ম থেকে আলাদা। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি অনুযায়ী, জেলা পরিষদে চেয়ারম্যান ও ৩৩ জন সদস্য ৫ বছর মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চুক্তির স্বাক্ষরকারী দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ‘পার্বত্য এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা নিয়ে আলাদা ভোটার তালিকা’ দাবি করেছে। এই সুযোগে বিগত সরকারগুলো কৌশলে নিজেদের দলীয় লোক দিয়ে অন্তর্বর্তী পরিষদ গঠন করেছে।
দুর্নীতির প্রধান তিন খাত
জেলা পরিষদে দুর্নীতি মূলত তিনটি ক্ষেত্রে বেশি দেখা যায়-
নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য – কর্মচারী নিয়োগে দীর্ঘদিন ধরেই ঘুষের অভিযোগ।
খাদ্যশস্য বরাদ্দে অনিয়ম – প্রকল্প কাগজে সম্পন্ন হলেও বাস্তবে জনগণের কাছে পৌঁছায় না।
ভুয়া উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ লোপাট – দলীয় ঠিকাদাররা অস্তিত্বহীন প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করে।
দুদকের অভিযান ও মামলা
সম্প্রতি দুদক পার্বত্য তিন জেলার জেলা পরিষদের বিভিন্ন দুর্নীতির তদন্তে নামেছে। প্রথমবারের মতো রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য, দুই প্রকৌশলী ও ঠিকাদারসহ নয়জনের বিরুদ্ধে চারটি মামলা দায়ের হয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জিরুনা ত্রিপুরাকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করা হয়েছে। বান্দরবানের চেয়ারম্যান ক্যশৈহালসহ আরও কয়েকজনের বিরুদ্ধেও তদন্ত চলছে।
দুদকের উপপরিচালক মো. জাহিদ কালাম বলেন, “অস্তিত্বহীন প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিযোগে চারটি মামলা হয়েছে। তদন্ত শেষে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, মামলাগুলো আদালতে বিচারাধীন।”
জনপ্রতিনিধির অভাবে একচেটিয়া প্রভাব
রাঙামাটি দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, “নির্বাচন না হওয়ায় পরিষদে একচেটিয়া প্রভাব তৈরি হয়েছে। জনগণের কাছে জবাবদিহি না থাকায় দুর্নীতির সুযোগ বেড়েছে।”
নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি জাহাঙ্গীর আলম মুন্না বলেন, “মনোনীত চেয়ারম্যান ও সদস্যরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন। নির্বাচিত না হলে তাদের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করা যায় না।”
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট দীননাথ তঞ্চঙ্গা বলেন, “নির্বাচনের মাধ্যমেই জেলা পরিষদে জবাবদিহি ফিরবে। বর্তমান কাঠামোয় তা সম্ভব নয়।”
রাঙামাটির মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা খোন্দকার মো. রিজাউল করিম বলেন, “প্রতিষ্ঠানের ভেতরে ভুলত্রুটি হওয়ার সুযোগ আছে। যাতে তা না হয়, আমরা সে বিষয়ে সতর্ক।”
পাহাড়ের এই তিন জেলার মানুষ দীর্ঘ ৩৬ বছর ধরে নির্বাচনের অধিকার থেকে বঞ্চিত, যার প্রভাব সরাসরি পড়েছে তাদের জীবনমান ও স্থানীয় উন্নয়নে।
সাম্প্রতিক দুদকের অভিযান আশা জাগাচ্ছে, তবে প্রকৃত সুশাসন ও জবাবদিহি ফিরতে হলে নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই।






