মার্কিন-ফিলিপাইন যৌথ মহড়া: বাশি চ্যানেল অবরোধের কৌশল

যুক্তরাষ্ট্র-ফিলিপাইন যৌথ সামরিক মহড়া: বাশি চ্যানেল অবরোধের কৌশল এবং চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা।
বিশ্ব ডেস্ক: ফিলিপাইনের উত্তরাঞ্চলীয় বাটানেস প্রদেশের সবুজ দ্বীপপুঞ্জে সাম্প্রতিককালে মিলিটারি হেলিকপ্টারের গর্জন শোনা গেলে স্থানীয়রা চমকে উঠেছিলেন। এই দূরবর্তী দ্বীপগুলো, যা তাইওয়ান থেকে মাত্র ৯০ মাইল দূরে অবস্থিত, কয়েক বছর আগে ছিল শান্তিপূর্ণ এবং অজানা।
কিন্তু এখন এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতার সামরিক সীমান্তে পরিণত হয়েছে। ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে প্রকাশিত রয়টার্সের একটি তদন্তমূলক প্রতিবেদন অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে সৈন্য এবং অ্যান্টি-শিপ মিসাইল মোতায়েন করেছে, যার মূল লক্ষ্য বাশি চ্যানেল অবরোধ করে চীনা যুদ্ধজাহাজগুলোকে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ থেকে বিরত রাখা – বিশেষ করে যদি বেইজিং তাইওয়ানে আক্রমণ চালায়।
বাশি চ্যানেল
কৌশলগত গুরুত্ব এবং অবরোধের পরিকল্পনা
বাশি চ্যানেল দক্ষিণ চীন সাগরকে পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে যুক্ত করে একটি সংকীর্ণ জলপথ, যা বাটানেস দ্বীপপুঞ্জের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত। এই চ্যানেলটি চীনের বিশাল নৌবাহিনীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার, বিশেষ করে তাইওয়ান আক্রমণ বা অবরোধের ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিপাইনের সামরিক পরিকল্পনাকারীরা এই চ্যানেলটিকে “চোক পয়েন্ট” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন, যেখান থেকে স্থলভিত্তিক অ্যান্টি-শিপ মিসাইল দিয়ে চীনা জাহাজগুলোকে দূরে রাখা সম্ভব।
সাবেক ফিলিপাইন জেনারেল এমানুয়েল বাউটিস্তা বলেছেন, “উত্তর ফিলিপাইন নিয়ন্ত্রণ না করলে তাইওয়ান আক্রমণ প্রায় অসম্ভব।” সাবেক রিয়ার অ্যাডমিরাল রমেল ওং যোগ করেছেন, “বাশি চ্যানেল নিয়ন্ত্রণ না করলে সংঘাতে জয় অর্জন করা যাবে না।”
এই কৌশলটি “ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইন” এর অংশ, যা জাপান থেকে বোর্নিও পর্যন্ত বিস্তৃত এবং চীনের নৌবাহিনীকে আবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্যে তৈরি। ফিলিপাইনের ৭,৬০০-এরও বেশি দ্বীপ এই চেইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগকারী।
২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে বাটানেসে যৌথ প্রশিক্ষণ চলছে, যাতে মার্কিন সেনা দুবার অ্যান্টি-শিপ মিসাইল লঞ্চার বিমানযোগে স্থাপন করেছে। এই মিসাইলগুলোর পাল্লা ৩০০ কিলোমিটারেরও বেশি, যা চ্যানেলটি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিতে সক্ষম।
যৌথ যুদ্ধ মহড়া
বালিকাতান এবং অন্যান্য অভিযান
যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিপাইনের বার্ষিক “বালিকাতান” (কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে) যৌথ মহড়াগুলো এবার সবচেয়ে বৃহৎ মাত্রায় পরিচালিত হচ্ছে। ২০২৫ সালের এপ্রিল-মে মাসে ১২,০০০ মার্কিন সৈন্য এবং ৬,০০০ ফিলিপাইনি সৈন্য অংশ নিয়েছে, যাতে অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানের সৈন্যরাও যোগ দিয়েছে।
এই মহড়ায় নেভি-মেরিন এক্সপেডিশনারি শিপ ইন্টারডিকশন সিস্টেম (এনএমইএসআইএস) এবং টাইফন মিড-রেঞ্জ মিসাইল সিস্টেম মোতায়েন করা হয়েছে।
এনএমইএসআইএস-এর নেভাল স্ট্রাইক মিসাইলের পাল্লা ১১০ নটিক্যাল মাইল, যা বাটান দ্বীপ থেকে তাইওয়ানের দক্ষিণ প্রান্ত পর্যন্ত কভার করে।
মহড়ায় একটি অবসরপ্রাপ্ত ফিলিপাইনি জাহাজ (এক্স-বিআরপি মিগুয়েল মালভার) ডুবিয়ে ফেলার অনুশীলন করা হয়েছে, যা তাইওয়ান যুদ্ধের সম্ভাব্য দৃশ্যপট অনুকরণ করে। এছাড়া, পালাওয়ান এবং লুজন দ্বীপে সৈন্য অবতরণ করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমি এবং অবকাঠামো দখলের অনুশীলন চলেছে। মার্কিন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জেমস গ্লিন বলেছেন, “এই পূর্ণ যুদ্ধ পরীক্ষা দক্ষিণ চীন সাগরের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার জন্য।”
২০২৬ সালে ৫০০-এরও বেশি যৌথ কার্যক্রম পরিকল্পিত, যাতে বড় প্রশিক্ষণ এবং বিশেষজ্ঞ বিনিময় অন্তর্ভুক্ত।
মার্কিন-ফিলিপাইন জোটের পুনরুজ্জীবন
১৯৯২ সালে সাবেক মার্কিন নৌঘাঁটি (সুবিক বে) বন্ধ হওয়ার পর প্রায় ৩০ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনে স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি তৈরি করছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ফার্দিনান্ড মার্কোস জুনিয়রের প্রশাসন এই সহযোগিতাকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে, যেখানে তার পূর্বসূরি রদ্রিগো দুতার্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি শত্রুতা পোষণ করেছিলেন। মার্কোস বলেছেন, “তাইওয়ান যুদ্ধে ফিলিপাইন অবশ্যই জড়িয়ে পড়বে।” মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ কংগ্রেসে জানিয়েছেন, ফার্স্ট আইল্যান্ড চেইনে চীনা আগ্রাসন রোধে ক্ষমতা আধুনিকীকরণ অগ্রাধিকার।
সেক্রেটারি অফ স্টেট মার্কো রুবিও ফিলিপাইনকে নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং সহায়তা মুক্তি দিয়েছেন।
চীনের প্রতিক্রিয়া এবং আঞ্চলিক উত্তেজনা
চীন এই মোতায়েনকে “উস্কানিমূলক” বলে প্রতিবাদ করেছে।
চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “তাইওয়ান চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এবং ফিলিপাইনকে বাহ্যিক শক্তি জড়াতে দেওয়া উচিত নয়।”
চীনা মিলিটারি বিশ্লেষক জাং জুনশে বলেছেন, এই মিসাইলগুলো চীনের দক্ষিণ-পূর্ব উপকূল, তাইওয়ান প্রণালী এবং উত্তর দক্ষিণ চীন সাগর কভার করে একটি ১,৮০০ কিলোমিটারের স্ট্রাইক নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে।
সম্প্রতি চীনা এয়ারক্র্যাফট ক্যারিয়ার “শাণ্ডং” এবং “লিয়াওনিং” বাশি চ্যানেল দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করেছে, যখন ফিলিপাইনি নৌবাহিনী চীনা জাহাজের অননুমোদিত প্রবেশ লক্ষ্য করেছে।
দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের “গ্রে-জোন” কৌশল – যেমন ফিলিপাইনের অর্থনৈতিক অঞ্চলে হয়রানি – উত্তেজনা বাড়িয়েছে। ফিলিপাইন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এগুলোকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছে। ফিলিপাইন ব্রাহমোস অ্যান্টি-শিপ মিসাইল (পাল্লা ৫০০ কিমি) কিনেছে, এবং যুক্তরাষ্ট্র লুজন দ্বীপে টাইফোন লঞ্চার মোতায়েন করেছে, যা টোমাহক মিসাইল দিয়ে ১,৬০০ কিমি পাল্লা রাখে।
স্থানীয় প্রভাব: ভয় এবং প্রস্তুতি
বাটানেসের ২০,০০০ বাসিন্দা যুদ্ধের ভয়ে খাদ্য মজুত করছেন। গভর্নর রোনাল্ড আগুতো সিভিল প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যাতে তাইওয়ান থেকে ফিলিপাইনি শ্রমিকদের প্রত্যাবর্তন এবং সম্ভাব্য তাইওয়ানি শরণার্থীদের জন্য পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত। ফিলিপাইন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, “আমরা ব্যাপক ঘটনা এবং প্রত্যাবর্তন পরিকল্পনা তৈরি করছি।”
স্থানীয় ফ্লোরেন্সিও আবাদ বলেছেন, “যুদ্ধ হলে বেঁচে থাকার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া দরকার।” সাবেক কমোডোর এডওয়ার্ড ইক দে সাগুন বলেছেন, বাটানেস লজিস্টিক হাব হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
নিরোধক বা উস্কানি?
ফিলিপাইন সরকার বলেছে, এই অস্ত্রগুলো প্রশিক্ষণ এবং নিরোধকের জন্য, কোনো নির্দিষ্ট দেশের বিরুদ্ধে নয়। সাবেক রিয়ার অ্যাডমিরাল ওং বলেছেন, “চীন যদি এতে রাগ করে, তাহলে এটি সঠিক কর্ম।” কিন্তু এই মহড়াগুলো আঞ্চলিক উত্তেজনা বাড়িয়েছে, যা তাইওয়ান ইস্যুতে “ফায়ার প্লে” এর ঝুঁকি তৈরি করছে।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ফিলিপাইনের জোট চীনের বিরুদ্ধে নিরোধক ক্ষমতা শক্তিশালী করছে, কিন্তু এটি কি শান্তি রক্ষা করবে নাকি সংঘাতকে আরও নিকটে নিয়ে আসবে – তা সময়ই বলবে।






