পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা উপস্থিতি: শান্তির ভরসা না অস্থিরতার কারণ?

পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনা উপস্থিতি: শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
বিশেষ প্রতিবেদন, বান্দরবান প্রতিনিধি: পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইচটি)—বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের ১৩,২৯৫ বর্গকিলোমিটারের এই কৌশলগত অঞ্চল—জাতীয় নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তির পরও এখানে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি অপরিহার্য বলে প্রমাণিত হয়েছে।
সরকারি তথ্য, স্থানীয় জনমত, নিরাপত্তা বিশ্লেষণ এবং উন্নয়ন প্রকল্পের ফলাফল থেকে স্পষ্ট যে, সেনাবাহিনী শুধু শান্তির রক্ষক নয়, উন্নয়নের চালিকাশক্তি এবং জাতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসাবে পাহাড়ে কাজ করে যাচ্ছে।
১. জাতীয় নিরাপত্তা ও সীমান্ত সুরক্ষা
সীমান্তের কৌশলগত গুরুত্ব: সিএইচটি মিয়ানমারের সাথে ৫১৮ কিলোমিটার সীমান্ত ভাগ করে। এখানে রোহিঙ্গা সংকট (২০১৭ থেকে ১১ লাখ+ উদ্বাস্তু), মাদক চোরাচালান (ইয়াবা, মেথামফেটামিন) এবং আন্তঃদেশীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশের ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশন (রাঙ্গামাটি সদর দপ্তর) এই সীমান্তে টহল, চেকপোস্ট এবং গোয়েন্দা কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২০২৪ সালে সেনাবাহিনী ১২০ কোটি টাকার ইয়াবা জব্দ করেছে (সূত্র: ডিজিএফআই রিপোর্ট)।
সশস্ত্র গোষ্ঠীর সক্রিয়তা রোধ: ২০২৫ সালের জানুয়ারি-অক্টোবর মাসে ১৫টি সংঘর্ষে ৮ জন নিহত হয়েছে (ইউপিডিএফ, কেএনএফ, জেএসএস-এর মধ্যে)। সেনাবাহিনীর টহল না থাকলে এই সংখ্যা ৩-৪ গুণ বাড়তো বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন। ২০২৪ সালে বান্দরবানে কেএনএফ-এর ব্যাংক ডাকাতি (২ কোটি টাকা লুট) সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে দমন করা হয়।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ন্ত্রণ: কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে অপরাধী গোষ্ঠী সিএইচটি-তে প্রবেশ করে। সেনাবাহিনী ২০২৩-২৫ সালে ৩৫০+ রোহিঙ্গা অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে, যা স্থানীয় অস্থিরতা রোধ করেছে।
২. শান্তিচুক্তির বাস্তবায়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষা
চুক্তির ধারা অনুসারে উপস্থিতি: ১৯৯৭ চুক্তির ১৭ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, স্থায়ী সেনানিবাস বহাল থাকবে। অস্থায়ী ক্যাম্পের সংখ্যা ৫০০ বেশী থেকে কমে ১১৩টিতে নেমেছে (২০১৬-২৫)। সরকার বলছে, এই ক্যাম্পগুলো জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।
স্থানীয় জনমতের সমর্থন: বান্দরবান জেলা পরিষদের ২০২৪ সালের জরিপে ৬৮% স্থানীয় (পাহাড়ি-বাঙালি উভয়) সেনা উপস্থিতিকে ‘শান্তির নিশ্চয়তা’ বলে মনে করেন। রাঙ্গামাটির দুর্গম গ্রামে রাতের টহল না থাকলে চাঁদাবাজি বাড়বে বলে ৭৪% উত্তরদাতা জানিয়েছেন।
৩. উন্নয়নমূলক কার্যক্রম: সেনাবাহিনীর অবদান
সেনাবাহিনী সিএইচটি-এর উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে।
স্বাস্থ্যসেবা: সেনা চিকিৎসা ক্যাম্প, মোবাইল মেডিকেল টিম।
২০২৪-২৫ সালে ১২০ বেশী ক্যাম্প পরিচালিত, ৫০,০০০ বেশী রোগীকে চিকিৎসা প্রদান।শিক্ষা: সেনা পরিচালিত স্কুল, শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ। ৩৫ বেশী স্কুল স্থাপিত, ১৫,০০০ বেশী শিক্ষার্থী উপকৃত।
অবকাঠামো: সড়ক, ব্রিজ, পানি প্রকল্প। ২০২৩-২৫ সালে ১৮০ কিলোমিটার সড়ক নির্মিত, ৪৫টি ব্রিজ তৈরি।
কৃষি ও খাদ্য: বীজ, সার, খাদ্য সহায়তা। ২০২৪ সালে ২০,০০০ বেশী পরিবারকে সহায়তা প্রদান।
এই কাজগুলো স্থানীয় প্রশাসনের সীমিত সক্ষমতার কারণে সম্ভব হয়েছে। রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেকের দুর্গম দ্বীপে সেনাবাহিনীই একমাত্র স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে।
৪. বিদেশি প্রভাব ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
অর্থায়নের প্রমাণ: ইউপিডিএফ এবং কেএনএফ-এর কার্যক্রমে বিদেশি অর্থায়নের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২০২৪ সালে গ্রেপ্তারকৃত ১২ জনের মোবাইলে ভারত, মিয়ানমার এবং ইউরোপীয় এনজিও থেকে লেনদেনের রেকর্ড পাওয়া যায়।
জাতিসংঘ ও এনজিও প্রতিবেদনের সমালোচনা
জাতিসংঘের ২০২৫ প্রতিবেদনে সেনা উপস্থিতিকে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’ বলা হয়েছে, কিন্তু এতে কোনো স্থানীয় সাক্ষ্য নেই। সরকার বলছে, এগুলো ‘একপাক্ষিক’ এবং সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রচারণার অংশ।
৫. স্থানীয় নেতৃত্ব ও জনপ্রতিনিধির মতামত
রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী (২০২৫) বলেন, “সেনাবাহিনী না থাকলে পাহাড়ে রাতে কেউ ঘুমাতে পারবে না। তারা আমাদের উন্নয়নের সঙ্গী।”
বান্দরবান পৌর মেয়র বলেন, “সেনা টহল বন্ধ হলে চাঁদাবাজি ৫০০% বাড়বে।”
সেনা উপস্থিতি—শান্তির ভিত্তি
পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কোনো ‘অকুপেশন’ নয়, বরং জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্থানীয় শান্তি এবং উন্নয়নের অপরিহার্য স্তম্ভ। চুক্তির ধারা মেনে অস্থায়ী ক্যাম্প কমানো হয়েছে, কিন্তু স্থায়ী উপস্থিতি সশস্ত্র গোষ্ঠী, বিদেশি ষড়যন্ত্র এবং সীমান্ত ঝুঁকির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। সেনাবাহিনীকে দুর্বল করা মানে পাহাড়কে অস্থিরতার মুখে ঠেলে দেওয়া বলে মনে করেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের বর্তমান দাবি, চুক্তির অসম্পূর্ণ ধারা (ভূমি কমিশন, আঞ্চলিক পরিষদ) বাস্তবায়ন, সেনার সিভিক অ্যাকশন প্রোগ্রাম সম্প্রসারণ, স্থানীয় প্রশাসনকে শক্তিশালী করা।
পাহাড়ের শান্তি টিকিয়ে রাখতে হলে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে রাজনৈতিক স্বার্থের ঊর্ধ্বে রেখে মূল্যায়ন করতে হবে। এটাই বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ।







