প্রথমবার জিটুজি ভিত্তিতে আমেরিকান গম আনলোড শুরু

যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রথম সরকারি গম আমদানি: শিপিং এজেন্ট আলী আকবরের মন্তব্যে উঠে এলো লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা।

বিশেষ প্রতিবেদন: বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার ও বৈদেশিক বাণিজ্য ভারসাম্য রক্ষার লক্ষ্যে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র থেকে সরকার টু সরকার (জিটুজি) ভিত্তিতে গম আমদানি শুরু করেছে বাংলাদেশ সরকার।

শনিবার (২৫ অক্টোবর) সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে মার্কিন জাহাজ ‘এমভি নর্স স্ট্রাইড’ ৫৭ হাজার মেট্রিক টন উচ্চমানের গম নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়।

এই প্রথম সরকারি পর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানি হওয়ায় এটি বাংলাদেশের বাণিজ্য ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তবে শিপিং এজেন্ট মোহাম্মদ আলী আকবরের মন্তব্যে উঠে এসেছে কিছু বাস্তব চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে আনলোডিং সময়সীমা, গুণমান পরীক্ষা এবং বন্দরের লজিস্টিক সক্ষমতা সম্পর্কিত বিষয়।

চুক্তির ও বাণিজ্য ঘাটতি সমন্বয়ের পদক্ষেপ

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি বর্তমানে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপের পর (৩৫%) এই ঘাটতি কমাতে আমদানি বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

ফলে গত ২০ জুলাই ২০২৫ তারিখে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের মহাপরিচালক আবু হাসনাত হুমায়ুন কবীর ও ইউএস হুইট অ্যাসোসিয়েটসের ভাইস প্রেসিডেন্ট জোসেফ কে. সাওয়ার-এর মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক (MoU) স্বাক্ষরিত হয়।

চুক্তি অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরে প্রতিবছর ৭ লাখ মেট্রিক টন আমেরিকান গম আমদানি করা হবে। প্রথম ধাপে চারটি জাহাজে মোট ২ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন গম আসবে। ভবিষ্যতে তুলা, সয়াবিনসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যও এই জিটুজি ব্যবস্থায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে।

জাহাজের আগমন ও আনলোডিং প্রক্রিয়া

‘এমভি নর্স স্ট্রাইড’ জাহাজটি ওয়াশিংটনের কালামা বন্দর থেকে রওনা দিয়ে ২৫ অক্টোবর সকালে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছায়। এর মধ্যে ৩৪,১৭০ টন গম চট্টগ্রামের করফলীমোহন সাইলো জেটিতে বুম সিস্টেমের মাধ্যমে আনলোড করা হবে, এবং বাকি ২২,৭৮৯ টন গম মোংলা বন্দরে পাঠানো হবে।

জাহাজের স্থানীয় এজেন্ট সেভেন সিজ শিপিং লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী আকবর জানান—

“স্যাম্পল পরীক্ষার কাজ শুরু হয়েছে। ফলাফল সন্তোষজনক হলে আনলোডিং সঙ্গে সঙ্গে শুরু হবে। গুণমান যাচাইয়ের কারণে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতে পারে।”

তিনি আরও বলেন, “৬০ শতাংশ গম চট্টগ্রাম বন্দরে আনলোড হবে, বাকিটা মোংলায়। অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও আবহাওয়া নির্ভরতা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।”

চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

“এটি বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। প্রথমবারের মতো সরকারি পর্যায়ে আমেরিকান গম এসেছে, যা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের স্টক ম্যানেজমেন্টকে শক্তিশালী করবে।”

তবে “যতক্ষণ বন্দরের লজিস্টিক সক্ষমতা উন্নত না হয়, ভবিষ্যতের চালানগুলোতে বিলম্বের ঝুঁকি থেকেই যাবে। আমাদের সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন।”

এই আমদানি শুধু খাদ্য সরবরাহ নয়, বরং বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নতুন মাত্রা তৈরি করবে।

অর্থনৈতিক প্রভাব: ইতিবাচক দিক

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ বছরে ১৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করলেও আমদানি মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলার। নতুন এই গম আমদানির ফলে ঘাটতি কিছুটা কমবে এবং দ্বিপাক্ষিক ভারসাম্য বাড়বে।

চুক্তির পর যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশি পণ্যের উপর শুল্ক ৩৫% থেকে কমিয়ে ২০% করেছে। এতে বছরে প্রায় ১-২ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে।

বাংলাদেশের বার্ষিক গম চাহিদা ৭.৬ মিলিয়ন টন, যার ৯৬% আমদানিনির্ভর। এই চুক্তি খাদ্যদ্রব্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সহায়ক হবে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সাবসিডি-ভিত্তিক বিতরণে সহায়তা করবে।

বর্তমান হিসাবের ঘাটতি কমবে, এবং আইএমএফ অনুযায়ী ২৭.৩৫ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ স্থিতিশীল থাকবে।

যদি স্থানীয় গম উৎপাদন বাড়ানো না হয়, তাহলে দীর্ঘমেয়াদে বিদেশি নির্ভরতা বিপদ ডেকে আনতে পারে।

আমদানি বাড়লে দেশীয় উৎপাদন (সফট ওয়েট গম) আরও কমবে, ফলে কৃষকদের আয় হ্রাসের ঝুঁকি রয়েছে।

মোট খরচ প্রায় ৮১৭.৫৭ কোটি টাকা (প্রতি টন ৩০২.৭৫ ডলার)। আন্তর্জাতিক দামের ওঠানামা বাজেটে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

বড় আকারে আমদানির ফলে সমুদ্র পরিবহনে কার্বন নির্গমন বাড়বে, যা পরিবেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

সরকারের পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, আমদানি করা গম সরাসরি সরকারি গুদামে সংরক্ষণ করা হবে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সাবসিডি-ভিত্তিক বিতরণ কর্মসূচিতে ব্যবহার হবে।
সরকার ভবিষ্যতে স্থানীয় উৎপাদন বাড়াতে ও জলবায়ু সহনশীল জাতের চাষে প্রণোদনা দেবে বলে জানিয়েছে।

এই গম আমদানি স্বল্পমেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ফলাফল পেতে স্থানীয় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, বন্দর অবকাঠামো উন্নয়ন ও উৎস বৈচিত্র্য অপরিহার্য।