গুন্ড্রেমিঙ্গেনে পারমাণবিক টাওয়ার ধ্বংস: জার্মানির ‘এনার্জিওয়েন্ডে’ নীতি

জার্মানির গুন্ড্রেমিঙ্গেনে পারমাণবিক টাওয়ার ধ্বংস: ‘এনার্জিওয়েন্ডে’ নীতির ঐতিহাসিক মাইলফলক।

বিশ্ব ডেস্ক: জার্মানির বাভারিয়া রাজ্যের গুন্ড্রেমিঙ্গেন শহরে অবস্থিত দুটি বিশাল পারমাণবিক কুলিং টাওয়ার শনিবার (২৫ অক্টোবর) দুপুরে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণের মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে। ১৬০ মিটার উচ্চতার এই টাওয়ারদ্বয়ের ধ্বংসযজ্ঞ ড্রোন ফুটেজে ধারণ করা হয়েছে, যা মুহূর্তেই ভাইরাল হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই ঘটনাকে জার্মানির পারমাণবিক শক্তি নির্ভরতা থেকে চূড়ান্ত বিচ্ছেদের প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে।

গুন্ড্রেমিঙ্গেন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র জার্মানির সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোর একটি ছিল। ১৯৮০ সালে টাওয়ারদ্বয় নির্মাণ শুরু হয় এবং ১৯৮৪ সালে এটি বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করে। প্রায় চার দশক ধরে এই কেন্দ্রটি বাভারিয়া ও আশপাশের এলাকাকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে এসেছে।

২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক দুর্ঘটনার পর জার্মানি পারমাণবিক শক্তি থেকে ধীরে ধীরে সরে আসার নীতি — “এনার্জিওয়েন্ডে” (Energiewende) — গ্রহণ করে। সেই নীতির অংশ হিসেবেই গুন্ড্রেমিঙ্গেন কেন্দ্রটি ২০২১ সালে স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয় এবং এর ধ্বংস কার্যক্রম ২০২৩ সালে শুরু হয়।

বিস্ফোরণ প্রক্রিয়া ও প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ

শনিবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা ০০ মিনিটে টাওয়ার দুটির নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ সম্পন্ন হয়। বিস্ফোরণে ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় ৬০০ কিলোগ্রাম ডাইনামাইট, যা ১,৮০০টি নির্দিষ্ট ছিদ্রে (boreholes) স্থাপন করা হয়।

প্রকৌশলীরা টাওয়ারগুলোকে নির্দিষ্ট দিকে ধসিয়ে পড়ার জন্য একটি জটিল ও নিখুঁত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন, যাতে আশপাশের স্থাপনা বা পরিবেশের কোনো ক্ষতি না হয়।

প্রত্যেক টাওয়ারের ওজন ছিল আনুমানিক ২৮,০০০ টন, এবং বিস্ফোরণের পর প্রায় ৫৬,০০০ টন কংক্রিট ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়। বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ জুড়ে বিশাল ধুলোর ঘূর্ণি দেখা যায়, যা কয়েক কিলোমিটার দূর থেকেও দৃশ্যমান ছিল।

নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পরিবেশগত প্রভাব

স্থানীয় প্রশাসন আগেই এলাকাবাসীকে সতর্ক করেছিল এবং বিস্ফোরণের সময় কেন্দ্র থেকে কয়েক কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।

জার্মান পরিবেশ সংস্থা (UBA) জানিয়েছে, বিস্ফোরণটি সম্পূর্ণ নিরাপদভাবে সম্পন্ন হয়েছে—কোনো রেডিওঅ্যাকটিভ পদার্থের নির্গমন বা পরিবেশ দূষণের ঝুঁকি তৈরি হয়নি। তবে ধুলার কারণে কয়েক ঘণ্টার জন্য স্থানীয়ভাবে বায়ুর মান সামান্যভাবে খারাপ হয়, যা দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসে।

গুন্ড্রেমিঙ্গেনের এই ধ্বংসযজ্ঞ শুধু একটি স্থাপনার অবসান নয়—এটি জার্মানির পারমাণবিক যুগের চূড়ান্ত অবসানের প্রতীক।
বাভারিয়ার পরিবেশমন্ত্রী ক্রিশ্চিয়ান বার্নার বলেন, “আজকের দিনটি আমাদের ‘এনার্জিওয়েন্ডে’ যাত্রার এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। জার্মানি এখন পূর্ণমাত্রায় নবায়নযোগ্য শক্তির যুগে প্রবেশ করছে।”

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

ধ্বংসাবশেষ সরাতে কয়েক মাস সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় প্রশাসন। পরবর্তীতে এই স্থানে একটি নবায়নযোগ্য শক্তি গবেষণা কেন্দ্র এবং সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

এই নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে জার্মানির বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক শক্তির অধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হলো। জার্মানি এখন সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুৎ নির্ভর শক্তি ব্যবস্থার দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে—একটি নতুন ‘সবুজ জার্মানি’র প্রতীক হিসেবে।

সূত্র: ২৬ অক্টোবর আল জাজিরা ও স্থানীয় সূত্রে সংগৃহীত