বান্দরবানে বিএনপির মনোনয়ন লড়াই: ‘ধান কাটার কৃষক’ কে হবেন?

বান্দরবান ৩০০ নং আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রতিযোগিতা

অসীম রায় (অশ্বিনী): আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান ৩০০ নং আসনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে দলে দলে উত্তেজনা ও আগ্রহ তৈরি হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের সংবেদনশীল এই আসনটিতে উপজাতি ও বাঙালি—দুই সম্প্রদায়ের ভোটারদের ভারসাম্য রক্ষা করেই প্রার্থী বাছাই করতে হচ্ছে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে।

দলীয় অভ্যন্তরে তিনজন হেভিওয়েট নেতার মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে, এবং এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখন কেন্দ্রীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে—কে হবেন ‘ধান কাটার কৃষক’, অর্থাৎ বিএনপির ‘ধানের শীষ’-এর প্রতীকধারী প্রার্থী?

কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক

গত রবিবার বিকেলে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রাম বিভাগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের নিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান শামীম। এতে বান্দরবান আসনের তিন প্রধান মনোনয়নপ্রত্যাশী অংশ নেন—রাজপুত্র সাচিং প্রু জেরী, মিসেস মাম্যাচিং এবং জাবেদ রেজা।

রাজপুত্র সাচিং প্রু জেরী বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, সাবেক জেলা সভাপতি এবং উপজাতি সমাজে প্রভাবশালী নেতা। তিনি অতীতে বান্দরবান জেলা পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং উপজাতি-বাঙালি সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে পরিচিত। মিসেস মাম্যাচিং, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির উপজাতি বিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক জেলা সভাপতি, পার্বত্য নারীদের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় নাম। তিনি পাহাড়ি নারীদের অধিকার রক্ষা ও স্থানীয় উন্নয়ন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। অন্যদিকে জাবেদ রেজা, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ও সাবেক পৌর মেয়র, যিনি পাহাড়ি ও বাঙালি উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয়।

বৈঠকে তিন প্রার্থীর সাংগঠনিক দক্ষতা, জনপ্রিয়তা, অতীত ত্যাগ ও তৃণমূলের যোগাযোগ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদসহ আরও কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত ছিলেন। আলোচনার সারসংক্ষেপ প্রেরণ করা হয়েছে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান-এর কাছে, যিনি ব্যক্তিগতভাবে ফোনে প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেবেন বলে জানা গেছে।

ঐক্যের বার্তা ও স্থানীয় প্রতিক্রিয়া

১১ অক্টোবর বান্দরবান জেলা বিএনপির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে এই তিন প্রার্থী ঐক্যবদ্ধ থাকার প্রতিশ্রুতি দেন। বৈঠকে সদস্য সচিব জাবেদ রেজা বলেন—“আমরা দলের সিদ্ধান্ত মেনে চলব, যিনি মনোনয়ন পাবেন, তার পক্ষে সবাই কাজ করব।”

এই বক্তব্য স্থানীয় পর্যায়ে প্রশংসিত হয়। তৃণমূল কর্মীদের মতে, যদি এই ঐক্য বাস্তবে রক্ষা করা যায়, তবে বান্দরবান আসনে বিএনপি অতীতের অবস্থান পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পার্বত্য অঞ্চলে দলীয় ঐক্য এবং উপজাতি-বাঙালি ভারসাম্যই হতে পারে বিএনপির সাফল্যের মূল উপাদান।

বান্দরবানের সংবেদনশীল রাজনৈতিক বাস্তবতা

বান্দরবান পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে সংবেদনশীল আসনগুলোর একটি। এখানে ভোটারদের প্রায় অর্ধেকই উপজাতি সম্প্রদায়ের, বাকিরা বাঙালি। এই কারণে প্রার্থী নির্বাচনে উভয় পক্ষের আস্থা অর্জন করা দলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

কেন্দ্রীয় এক নেতা জানান, “তারেক রহমান বিশেষভাবে পার্বত্য আসনগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন। বান্দরবানে তিনি এমন একজন প্রার্থী খুঁজছেন, যিনি ঐক্যের প্রতীক হিসেবে কাজ করতে পারবেন।”

অন্যদিকে, বিএনপি এখানে শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে নয়, বরং জামায়াতে ইসলামি, পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস) এবং অন্যান্য আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠনের সাথেও ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে যাচ্ছে। স্থানীয় রাজনীতিতে জাতিগত বিভাজন ও সামাজিক প্রভাবের জটিল সমীকরণ বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গুজব বনাম বাস্তবতা: সোশ্যাল মিডিয়ায় মনোনয়ন তালিকা

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বান্দরবানসহ চট্টগ্রাম বিভাগের কয়েকটি আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নামের তালিকা ভাইরাল হয়। সেখানে বান্দরবানের প্রার্থী হিসেবে বিভিন্ন নাম ঘুরে বেড়ালেও, বিএনপির কেন্দ্রীয় দফতর দ্রুতই এক বিবৃতি দিয়ে এসব তথ্যকে “মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর” বলে দাবি করে।
বিবৃতিতে বলা হয়, “সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত মনোনয়ন তালিকা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর। এখনো কোনো আসনে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়নি।”

বর্তমানে বিএনপি মোট ২০৬টি আসনে প্রার্থী চূড়ান্তকরণের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। বান্দরবানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি আসনে (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান) মাঠপর্যায়ের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের কাজ চলছে। এরপর তারেক রহমানের অনুমোদনক্রমে মনোনয়ন ঘোষণা করা হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।

বান্দরবানে বিএনপির ঐতিহ্য

বান্দরবান আসনে বিএনপির ঐতিহাসিক উপস্থিতি রয়েছে। ১৯৭৯ সালের সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী অংশাই প্রু চৌধুরী এই আসনে বিজয়ী হন এবং পরে বিএনপিতে যোগ দেন। তিনিই ছিলেন পার্বত্য রাজনীতিতে বিএনপির প্রথম প্রভাবশালী মুখ।
২০০১ সালের নির্বাচনেও বিএনপি এখানে শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখে। তবে পরবর্তী বছরগুলোতে আঞ্চলিক দল ও আওয়ামী লীগের সংগঠিত প্রচারণায় সেই প্রভাব কমে যায়। বর্তমান নেতৃত্ব সেই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে।

স্থানীয় নেতারা বলছেন, দলীয় ঐক্য ও তৃণমূল সক্রিয়তা বাড়লে বান্দরবানে বিএনপি আবারও শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে পারবে। এই প্রক্রিয়ায় জেলা বিএনপির নবীন নেতৃত্ব এবং কেন্দ্রীয় নির্দেশনা সমন্বয় করেই ‘ধান কাটার কৃষক’-এর জয় নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

নির্বাচন প্রস্তুতি ও আগামীর লড়াই

নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। ফলে মনোনয়ন চূড়ান্ত করার জন্য বিএনপির হাতে সময় সীমিত। এই প্রেক্ষাপটে দলটি বান্দরবানসহ পার্বত্য আসনগুলোতে মাঠ পর্যায়ের জরিপ চালাচ্ছে।

স্থানীয় পর্যায়ের একজন সিনিয়র নেতা বলেন, “যে প্রার্থীকে ধানের শীষের দায়িত্ব দেওয়া হবে, তিনিই হবেন বান্দরবানের ‘ধান কাটার কৃষক’—উন্নয়ন, ঐক্য ও পুনর্জাগরণের প্রতীক।”

বান্দরবান ৩০০ নং আসনে এখনো চূড়ান্তভাবে জানা যায়নি কে হবেন বিএনপির প্রার্থী। তবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নজর এখন ঐক্য, গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তার সমন্বয়ে।

রাজপুত্র সাচিং প্রু জেরী, মিসেস মাম্যাচিং ও জাবেদ রেজা—এই তিনজনের মধ্যে যিনি জনগণের আস্থা ও ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠতে পারবেন, তিনিই হতে পারেন বান্দরবানের ‘ধান কাটার কৃষক’।

বান্দরবান আসনের ভাগ্য নির্ধারণ করবে দলীয় ঐক্য, পার্বত্য জনমতের ভারসাম্য এবং তৃণমূলের জনসংযোগের শক্তি।