সামরিক সরকারের ডিক্রি: রাজোলিনা আর মাদাগাস্কারের নাগরিক নন

মাদাগাস্কারের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোলিনার নাগরিকত্ব বাতিল: রাজনৈতিক প্রতিশোধের নতুন অধ্যায়।
বিশ্ব ডেস্ক: মাদাগাস্কারের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট আন্দ্রি রাজোলিনার নাগরিকত্ব বাতিল করেছে দেশের নতুন সামরিক-নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। ২৪ অক্টোবর প্রকাশিত সরকারি ডিক্রির মাধ্যমে রাজোলিনার মাদাগাস্কারি নাগরিকত্ব বাতিল করে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফরাসি নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
মাত্র ১০ দিন আগে সংঘটিত সামরিক অভ্যুত্থানের পর এই সিদ্ধান্ত দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে এক নতুন অস্থিরতার সূচনা করেছে।
অভ্যুত্থানের: আন্দোলন থেকে সামরিক দখল
সেপ্টেম্বরের শেষদিকে শুরু হওয়া যুব-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের মধ্যেই সরকারের বিরুদ্ধে জনঅসন্তোষ বিস্ফোরিত হয়। বিক্ষোভকারীরা বিদ্যুৎ সংকট, মূল্যস্ফীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে।
১১ অক্টোবর পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়, যখন ক্যাপস্যাট (CAPSAT) নামে পরিচিত একটি অভিজাত সামরিক ইউনিট ঘোষণা করে যে তারা আর রাজোলিনার নির্দেশ মেনে চলবে না। এই ইউনিটের নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল মাইকেল রান্ড্রিয়ানিরিনা, যিনি পরবর্তীতে রাজোলিনাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেন।
১৪ অক্টোবর মাদাগাস্কারের উচ্চ সাংবিধানিক আদালত রাজোলিনার ক্ষমতাচ্যুতি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে, এবং তিনি দেশত্যাগ করেন। ১৭ অক্টোবর রান্ড্রিয়ানিরিনা অন্তর্বর্তীকালীন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শপথ নেন ও দুই বছরের মধ্যে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দেন।
নাগরিকত্ব বাতিল: পুরনো বিতর্কের পুনর্জাগরণ
নতুন প্রধানমন্ত্রী হেরিন্তসালামা রাজাওনারিভেলো স্বাক্ষরিত ডিক্রিতে বলা হয়, রাজোলিনা ২০১৪ সালে স্বেচ্ছায় ফ্রান্সের নাগরিকত্ব গ্রহণ করায় তাঁর মাদাগাস্কারি নাগরিকত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হয়েছে।
১৯৬০ সালের Nationality Code অনুযায়ী, অন্য দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করলে স্বদেশি নাগরিকত্ব হারানোর বিধান রয়েছে।
এই বিষয়টি প্রথম প্রকাশ্যে আসে ২০২৩ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে, যখন জানা যায় রাজোলিনার ফরাসি পাসপোর্ট আছে। তিনি দাবি করেন, এটি শুধুমাত্র সন্তানদের ফ্রান্সে পড়াশোনার সুবিধার জন্য নেওয়া হয়েছিল।
তবে বিরোধী দলগুলো বিষয়টিকে রাষ্ট্রীয় বেআইনি কাজ বলে চিহ্নিত করে তাঁকে অযোগ্য প্রার্থী ঘোষণা করার দাবি তোলে। বিতর্ক সত্ত্বেও রাজোলিনা নির্বাচনে জয়ী হন, যদিও তা বিরোধী দলগুলোর বয়কট করা নির্বাচন ছিল।
নতুন সরকারের চোখে এটি এখন একটি আইনি ভিত্তিতে নেওয়া প্রতিশোধমূলক সিদ্ধান্ত, যা তাঁকে মাদাগাস্কারের রাজনীতিতে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করে দিল।
অর্থপাচার ও দুর্নীতির অভিযোগের ছায়া
রাজোলিনার নাগরিকত্ব বাতিলের খবরের পরদিনই তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগী মামিনিয়ানা রাভাতোমাঙ্গা–কে মরিশাসের ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম কমিশন (FCC) গ্রেপ্তার করে।
রাভাতোমাঙ্গা রাজোলিনার প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও অর্থায়নকারী ছিলেন, এবং তাঁর বিরুদ্ধে অর্থপাচার ও দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে।
এই ঘটনায় রাজোলিনার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের দুর্নীতির অভিযোগ আবারও আলোচনায় এসেছে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আফ্রিকান ইউনিয়ন (AU) ইতিমধ্যে মাদাগাস্কারের সদস্যপদ স্থগিত করেছে এবং সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে।
ফ্রান্স এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি, তবে রাজোলিনার ফরাসি নাগরিকত্বের কারণে বিষয়টি প্যারিস–অ্যান্টানানারিভো সম্পর্ককে প্রভাবিত করতে পারে বলে বিশ্লেষকদের আশঙ্কা।
নতুন সরকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাবে কিনা, তা এখন নির্ভর করছে তাদের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি পালনের ওপর।
জনমত ও ভবিষ্যতের সংকেত
সোশ্যাল মিডিয়ায় এই সিদ্ধান্তকে ঘিরে মতভেদ স্পষ্ট।যুবসমাজ একে “বিচারের জয়” হিসেবে দেখছে, আবার অনেকেই এটিকে “রাজনৈতিক প্রতিশোধের কৌশল” বলে আখ্যা দিয়েছে।
রাজোলিনার সমর্থকরা এখনো নীরব, আর তাঁর অবস্থান অজানা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, “এই পদক্ষেপ হয়তো রাজনীতিতে স্থিতি আনতে পারে, তবে একইসাথে নতুন অস্থিরতার বীজ বপন করেছে।”
মাদাগাস্কারের রাজনীতি আবারও এক অনিশ্চিত পথে।
প্রেসিডেন্ট রাজোলিনার নাগরিকত্ব বাতিলের মাধ্যমে একদিকে দুর্নীতি ও দ্বৈত নাগরিকত্বের প্রশ্নে কঠোর অবস্থান দেখাল নতুন সরকার।
অন্যদিকে এটি একটি “রাজনৈতিক প্রতিশোধের নতুন অধ্যায়” হিসেবেও ইতিহাসে স্থান করে নিল।






