২৬ বছরে এমটিবি: আস্থা, উদ্ভাবন ও সাফল্যের যাত্রা

১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এমটিবি আজ শুক্রবার উদযাপন করছে ২৬তম বার্ষিকী; প্রতিষ্ঠাতা থেকে বর্তমান চেয়ারম্যানদের নেতৃত্বে ব্যাংকটি হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বিশ্বস্ত ও উদ্ভাবনী প্রতীক।
বদিউল আলম লিংকন: মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি (এমটিবি) আজ শুক্রবার তার ২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করবে। ১৯৯৯ সালের ২৪ অক্টোবর বাংলাদেশ ব্যাংকের লাইসেন্সপ্রাপ্তির পর যাত্রা শুরু করা এই ব্যাংক আজ দেশের অর্থনীতিতে একটি অপরিহার্য শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
বার্ষিকী উদযাপনটি ২৪ অক্টোবরের আগে ও পরে ছড়িয়ে আয়োজন করা হয়েছে, যাতে দেশের সব শাখা, গ্রাহক ও কর্মী অংশগ্রহণ করতে পারে।
ব্যাংকটির এজিএম (বার্ষিক সাধারণ সভা) সাধারণত জুলাই মাসে অনুষ্ঠিত হলেও ব্যাংকের সামাজিক দায়িত্ব (CSR) কার্যক্রম—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ ও নারীর ক্ষমতায়ন—সারা বছর ধরে চলে।
১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত দ্রুত পরিবর্তনের মুখে ছিল। নতুন ব্যাংক গঠন ও গ্রাহকসেবা সম্প্রসারণের সুযোগ তখনি তৈরি হচ্ছিল। এমটিবি সেই সময় প্রতিষ্ঠিত হয়, যার লক্ষ্য ছিল আধুনিক ব্যাংকিং সেবা প্রদান ও সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীদের আর্থিক স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করা। প্রতিষ্ঠা থেকেই ব্যাংকটি গ্রাহককেন্দ্রিক সেবা, সঞ্চয় পরিকল্পনা, ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক ঋণ এবং বিনিয়োগ সেবা চালু করে।
মাল্টিপল শাখা খোলা, আধুনিক ব্যাংকিং প্রযুক্তি ব্যবহার এবং গ্রাহকসেবায় মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে এমটিবি দ্রুতই গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করে। প্রতিযোগিতামূলক ব্যাংকিং খাতে এই ছোট প্রতিষ্ঠান দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রাথমিক বছরগুলোতে ব্যাংকটি সহজ, স্বচ্ছ এবং নির্ভরযোগ্য সেবা প্রদানে জোর দেয়। ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এবং ব্যক্তিগত গ্রাহকদের কাছে এমটিবি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক আজ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে আস্থা ও উদ্ভাবনের প্রতীক। ২৬ বছরে ১১৯ শাখা, ৩৩ সাব-ব্রাঞ্চ, ২০০ এজেন্ট ব্যাংকিং সেন্টার, ৩১০টি এটিএম, ৩২০০+ পিওএস মেশিন ও ডিজিটাল ডিপোজিট ১০০ কোটি টাকার অতিক্রম—সব মিলিয়ে ব্যাংকের আর্থিক শক্তি এবং স্থিতিশীলতা প্রমাণিত।
প্রতিষ্ঠার দর্শন ও লক্ষ্য
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই “গ্রাহকের স্বপ্ন পূরণ, আস্থা ও উদ্ভাবন” কে মূল উদ্দেশ্য হিসেবে গ্রহণ করে। শুধুমাত্র আর্থিক লেনদেন নয়, বরং গ্রাহকের জীবনকে সহজ ও সমৃদ্ধ করা ব্যাংকের মূল লক্ষ্য। “Line of Trust” নীতি প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই আস্থা এবং স্বচ্ছতার প্রতীক হিসেবে দাঁড়ায়। এই নীতিই ব্যাংককে গ্রাহক, কর্মী এবং সমাজের মধ্যে বিশ্বস্ত ও পরিচিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছে।
চেয়ারম্যানদের গৌরবময় নেতৃত্ব ও দেশের পরিচিত কয়েকটি মুখ-
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান – সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী (১৯৯৯–২০১৬)
এমটিবি-এর যাত্রা শুরু হয় সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর দূরদৃষ্টিতে। তিনি অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বাব) ও এমসিসিআই-এর সাবেক প্রেসিডেন্ট। তাঁর নেতৃত্বে ব্যাংকটি উদ্ভাবনী আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিকশিত হয়। শাখা সংখ্যা বৃদ্ধি পায় ১১৯-এ এবং ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের ভিত্তি স্থাপিত হয়।
তিনি “বিজনেস এক্সিকিউটিভ অব দ্য ইয়ার ২০০০” এবং “বিজনেস পার্সন অব দ্য ইয়ার ২০০২” পুরস্কার অর্জন করেন। ২০২৫ সালের ১২ মার্চ সিঙ্গাপুরে মৃত্যুবরণ করেন।
স্যামসন এইচ. চৌধুরী-প্রতিষ্ঠাতা
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি (এমটিবি) এই গৌরবময় যাত্রায় স্কয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা স্যামসন এইচ. চৌধুরীর অবদান একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কয়ার গ্রুপ এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে এমটিবি-এর উন্নয়নে তাঁর পরোক্ষ অবদান অপরিসীম।
স্যামসন এইচ. চৌধুরী, যিনি বাংলাদেশের শিল্পোদ্যোগের পথিকৃৎ, তাঁর দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি এবং ব্যাংকিং খাতে গভীর প্রভাব ফেলেছেন।
আরশাদ আহমেদ চৌধুরী (২০১৬–২০২৩)
চেয়ারম্যান পদে যোগদানের সময় চৌধুরী ব্যাংকের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা ও কর্পোরেট গভর্ন্যান্স শক্তিশালী করেন। তাঁর নেতৃত্বে ব্যাংক আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করে এবং ২০১৯ সালে দ্য ডেইলি স্টারের “বেস্ট-রান ব্যাংক” হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
এম. আবদুল মালেক (২০২৩–২০২৪)
মালেক ব্যাংকের বোর্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটি শক্তিশালী করেন এবং ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ত্বরান্বিত করেন। তাঁর আমলে ২০২২ সালে ৫ বিলিয়ন টাকার বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে ব্যাংকের মূলধন বৃদ্ধি হয়।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী (পুনরায় ২০২৪–২০২৫)
দ্বিতীয় মেয়াদে এমটিবি-এর সিএসআর কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়, নিলুফার মঞ্জুর মেমোরিয়াল স্কলারশিপ পরিচালনা করা হয়।
বর্তমান চেয়ারম্যান রাশেদ আহমেদ চৌধুরী (২০২৫ থেকে) দূরদর্শী নেতৃত্বে এমটিবি
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি)-এর বর্তমান চেয়ারম্যান হিসেবে ২০২৫ সালের ১ মে দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাশেদ আহমেদ চৌধুরী। তিনি এর আগে ভাইস চেয়ারম্যান এবং বোর্ড এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর নেতৃত্বে ২০২৫ সালে এমটিবি ইউরোমানি অ্যাওয়ার্ডসে “বাংলাদেশের সেরা ডিজিটাল ব্যাংক” হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে, যা ব্যাংকের ডিজিটাল ব্যাংকিং উৎকর্ষতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
চৌধুরী ২০১৬ সাল থেকে এমটিবি’র বোর্ডে যুক্ত আছেন। সেই বছরই তিনি বোর্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটির (বিআরএমসি) চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন এবং ব্যাংকের আর্থিক ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে আরও দৃঢ় ও কার্যকর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পরবর্তীতে, ২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর বোর্ড মিটিংয়ে তিনি ভাইস চেয়ারম্যান ও এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তাঁর নেতৃত্বে এমটিবি কর্পোরেট গভর্ন্যান্সে স্বচ্ছতা ও দক্ষতা অর্জন করে।
ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে রাশেদ আহমেদ চৌধুরী বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য জগতে এক পরিচিত নাম। তিনি ওয়েস্ট লন্ডন কলেজ থেকে বিজনেস স্টাডিজে হায়ার ন্যাশনাল ডিপ্লোমা এবং কিংসটন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য থেকে বিজনেস ম্যানেজমেন্টে পোস্টগ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি অর্জন করেছেন। এছাড়া তিনি ইউকে-এর চার্টার্ড ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের একজন সক্রিয় সদস্য।
বর্তমানে তিনি অ্যাসোসিয়েটেড বিল্ডার্স কর্পোরেশন লিমিটেড (এবিসি)-এর পরিচালক এবং এবিসি রিয়েল এস্টেটস লিমিটেড-এর পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পাশাপাশি, তিনি এবিসি বিল্ডিং প্রোডাক্টস লিমিটেড এবং বাঙ্গা গার্মেন্টস লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নির্মাণ, রিয়েল এস্টেট এবং পোশাক শিল্পে তাঁর অভিজ্ঞতা এমটিবি’র ব্যবসায়িক কৌশল ও সম্প্রসারণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
রাশেদ আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে এমটিবি এখন শুধু একটি ব্যাংক নয়—বরং “বিশ্বাস ও সম্ভাবনার সীমাহীন প্রতীক” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, যেখানে উদ্ভাবন, ডিজিটাল সেবা ও গ্রাহক আস্থা একসাথে অগ্রগতির নতুন ইতিহাস গড়ছে।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও: সৈয়দ মাহবুবুর রহমান
২০১৯ সালের নভেম্বর থেকে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি (এমটিবি)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (এমডি ও সিইও) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সৈয়দ মাহবুবুর রহমান। বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের একজন দূরদর্শী ও উদ্ভাবনী নেতা হিসেবে তিনি এমটিবি-কে একটি আধুনিক, ডিজিটাল ও গ্রাহককেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করেছেন।
তাঁর নেতৃত্বে এমটিবি ৩১০টি এটিএম, ৩২০০টিরও বেশি পিওএস মেশিন এবং উন্নত মোবাইল অ্যাপ ‘এমটিবি নিও’-এর মাধ্যমে সারা দেশে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা বিস্তার করেছে। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ব্যাংকের ডিজিটাল ডিপোজিট ১০০ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে, যা বাংলাদেশের ডিজিটাল ব্যাংকিং ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য অর্জন।
২০২৫ সালে এমটিবি “ইউরোমানি অ্যাওয়ার্ডস ফর এক্সেলেন্স”-এ “বাংলাদেশের সেরা ডিজিটাল ব্যাংক” স্বীকৃতি অর্জন করে, যা তাঁর কৌশলগত নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল প্রমাণ। একই বছর তিনি “বেস্ট ব্যাংকিং এমডি অ্যান্ড সিইও অব দ্য ইয়ার ২০২৫” পুরস্কারে ভূষিত হন।
সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে এমটিবি “লাইন অব ট্রাস্ট” এবং “এন্ডলেস পসিবিলিটিস” নীতিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে। তাঁর উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা, গ্রাহকমুখী দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক দায়বদ্ধতার সমন্বয়ে ব্যাংক শুধু আর্থিকভাবে শক্তিশালী হয়নি, বরং সমাজের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
তাঁর দূরদর্শী দিকনির্দেশনায় এমটিবি আজ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের এক উজ্জ্বল ও নির্ভরযোগ্য প্রতীক—যা উদ্ভাবন, আস্থা এবং মানবিক মূল্যবোধের সমন্বয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে।
সামাজিক দায়বদ্ধতা (CSR)
ব্যাংক বছরের বিভিন্ন সময়ে সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রম চালায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবেশ সংরক্ষণ, নারীর ক্ষমতায়ন—এসব ক্ষেত্রে এমটিবি উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এমটিবি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে নিলুফার মঞ্জুর মেমোরিয়াল স্কলারশিপও চালু করা হয়েছে।
আজ শুক্রবার, ২৬ বছরের এই যাত্রায় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক পিএলসি শুধু আর্থিক সেবা প্রদানেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি গ্রাহকের স্বপ্ন পূরণ, উদ্ভাবন এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রতীক হিসেবে দেশের ব্যাংকিং খাতে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে পরিচিত।







