মাচসিং মারমার ‘স্টুডেন্ট বক্স’: অভাব থেকে উঠে এসে শিক্ষার্থীদের পাশে

‘অভাবে বেড়ে উঠা’ এখন অন্যের পাশে— মাচসিং মারমার ‘স্টুডেন্ট বক্স’: টাকার অভাবে ক্ষুধার্ত ছিলেন, আজ শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে খাদ্য সরবরাহ করছেন

অসীম রায় (অশ্বিনী): ঢাকার মোহাম্মদপুরের রাজিয়া সুলতানা রোডে অবস্থিত ছোট্ট ‘তংসা বাজার’—এখানে পাহাড়ি ফল-সবজি, মধু, চাল, শুঁটকি এবং স্থানীয় মশলার পাশাপাশি রয়েছে একটি বিশেষ কোণ: ‘স্টুডেন্ট বক্স’। এই বক্সটি বিনামূল্যের, যেখান থেকে আর্থিক সংকটে থাকা শিক্ষার্থীরা চুপচাপ নিয়ে যেতে পারেন আলু, বেগুন, ডাল বা মৌসুমি ফল।

এই মানবিক উদ্যোগের পেছনে রয়েছেন বান্দরবানের তরুণী মাচসিং মারমা, যিনি নিজে অভাবের কঠিন যাত্রা পার হয়ে এসেছেন। একসময় টাকার অভাবে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ক্লাস করেছেন তিনি, আজ অন্য শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।

এই গল্প শুধু একটি ব্যবসার সাফল্য নয়, বরং অভাবের মধ্যে থেকে উঠে আসা একটি অনুপ্রেরণামূলক যাত্রা। মাচসিংয়ের উদ্যোগটি ঢাকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যদিও সোশ্যাল মিডিয়ায় এখনও বড় আলোচনা শুরু হয়নি। স্থানীয় সূত্র অনুসারে, এই বক্সটি শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থী সপ্তাহে এর সুবিধা নিচ্ছেন।

‘তংসা বাজার’ থেকে ‘স্টুডেন্ট বক্স’-এর যাত্রা

মাচসিং মারমা চলতি বছরের ৩ জুলাই শুরু করেন ‘তংসা বাজার’। এটি একটি ছোট দোকান, যেখানে রাসায়নিকমুক্ত পাহাড়ি ফল-সবজি, মধু, চাল, শুঁটকি এবং স্থানীয় মশলা বিক্রি হয়। বাজারটি সপ্তাহে দুই দিন—রবিবার এবং বৃহস্পতিবার—সকাল ৬টা থেকে ১১টা পর্যন্ত হাট বসে, অন্যান্য দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রথম দিনেই তিনি বিক্রি করেন ১৩ হাজার টাকার পণ্য, যা তার ব্যবসার সাফল্যের প্রথম সংকেত। বান্দরবানের পাহাড়ি গ্রাম থেকে আনা এই পণ্যগুলো ঢাকাবাসীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসচেতন গ্রাহকদের কাছে।

ব্যবসা কিছুটা স্থিতিশীল হওয়ার সাথে সাথেই মাচসিং শুরু করেন ‘স্টুডেন্ট বক্স’-এর মতো মানবিক উদ্যোগ। এই বক্সে রাখা হয় বিভিন্ন সবজি, ডাল এবং মৌসুমি ফল, যা শিক্ষার্থীরা বিনামূল্যে নিতে পারেন। মাচসিং বলেন, “ঢাকায় অনেক শিক্ষার্থী আছেন যারা টিউশনি না পেলে এক বেলা খেয়ে থাকেন। কেউ বাজারে যেতে লজ্জা পান, কেউ পারেও না। তাদের জন্যই এই বক্স। যাঁদের প্রয়োজন, তাঁরা যেন চুপচাপ এসে নিয়ে যেতে পারেন। কোনো প্রশ্ন করা হয় না, কোনো নাম জানা লাগে না।”

এই উদ্যোগের খরচ মাচসিং নিজের ব্যবসার লাভ থেকে চালান। সপ্তাহে দুই-তিনবার বক্সটি পূর্ণ করে রাখা হয়, এবং এটি দোকানের এক কোণায় রাখা থাকে যাতে গ্রাহকরা লক্ষ্য না করে। স্থানীয় শিক্ষার্থীদের মতে, এটি তাদের জন্য একটি নীরব সহায়তা, যা লজ্জা ছাড়াই সাহায্য নেওয়ার সুযোগ দেয়।

‘অভাবের ভেতর বেড়ে ওঠা’: মাচসিংয়ের জীবনী

মাচসিং মারমার জীবন অভাব, অনিশ্চয়তা এবং একাকীত্বের গল্প। বান্দরবানের এক পাহাড়ি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই মা-বাবা আলাদা হয়ে যান, যা তার শৈশবকে চিরতরে বদলে দেয়। “প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময় মা-বাবা আলাদা হয়ে যান। তখনও বুঝতাম না, কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝে গেছি কীভাবে ভাঙা সংসার একটা শিশুকে একা করে দেয়,” বলেন মাচসিং।

মা একাই চালাতেন তেলের দোকান, ছোট হোটেল এবং মুদির ব্যবসা। ছোট মাচসিং দোকানের হিসাব রাখতেন। বাবার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন ছিল বছরের পর বছর। পরে মা-বাবা দুজনই নতুন সংসার গড়েন, কিন্তু মাচসিং মায়ের সাথেই থাকেন। মায়ের দ্বিতীয় স্বামীকে বিদেশ পাঠাতে দোকানের টাকা খরচ হয়, কিন্তু তিনি বিদেশে গিয়ে আরেকটি বিয়ে করেন। ফলে ঋণের বোঝা চেপে বসে, ব্যবসা ভেঙে পড়ে এবং মা মানসিক ভারসাম্য হারান। মাচসিং তখন মাসির বাড়িতে আশ্রয় নেন।

নবম শ্রেণিতে ওঠার সময় ছয় মাস স্কুলে যাননি; মাসির চায়ের দোকানে কাজ করেন—চা বানানো, গ্লাস ধোয়া সবই তার দায়িত্ব। পরে বাবা তাকে একটি মেসে রাখেন। প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়িতে গিয়ে ৯ জনের রান্না করতে হতো। বাবা মাসে ১৫০ টাকা বাজার খরচ দিতেন, চাল বাড়ি থেকে আসতো। “এমনও দিন গেছে, এক কেজি আলু কিনে দু-তিন সপ্তাহ চালিয়েছি,” স্মরণ করেন মাচসিং। এভাবেই এসএসসি পাস করেন। বাবা বিয়ের চাপ দিলেও, তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান।

চট্টগ্রাম বন্দর মহিলা কলেজে ভর্তি হন, যেখানে প্রিন্সিপাল তার গল্প জেনে বিনা টাকায় পড়ার সুযোগ দেন। টিউশনি করে মাসে ২,০০০ টাকা আয় করেন, মা দিতেন আরও ২,০০০। সহপাঠী লেজে কেয়ার পরিবার তাকে মেয়ের মতো ভালোবাসে। পরে ঢাকায় গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান সায়েন্সে চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট বিষয়ে ভর্তি হন।

স্বপ্ন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

মাচসিংয়ের স্বপ্ন বড়—একটি সুপারশপ খোলা, যেখানে স্থানীয় ও পাহাড়ি কৃষকরা সরাসরি পণ্য বিক্রি করতে পারবেন। পাশাপাশি ‘স্টুডেন্ট বক্স’-এর শাখা দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়া চান। “আমি একসময় কষ্টে থেকেও মানুষ পেয়েছি, যারা বিশ্বাস করেছিল আমি পারব। এখন আমার পালা অন্যের পাশে দাঁড়ানোর,” বলেন তিনি।

এই উদ্যোগটি বাংলাদেশের পাহাড়ি সম্প্রদায়ের উদ্যোক্তাদের জন্য অনুপ্রেরণা। মাচসিংয়ের মতো আরও তরুণরা এমন উদ্যোগ নিলে সমাজের অভাবী শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।