মিয়ানমারের অভ্যন্তরে তীব্র সংঘর্ষ: ঘুমধুম সীমান্তে আতঙ্ক

মিয়ানমারে তীব্র সংঘর্ষ, ঘুমধুম সীমান্তে রাতভর গুলির শব্দে আতঙ্ক—বিজিবির টহল জোরদার।

বান্দরবান প্রতিনিধি: বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্ত এলাকায় মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের কারণে সীমান্তজুড়ে তীব্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। সোমবার (২০ অক্টোবর) রাত সাড়ে ৯টার দিকে আন্তর্জাতিক সীমান্তের ৩৪ নম্বর পিলার সংলগ্ন মিয়ানমারের ভেতরে তুমুল গোলাগুলির শব্দ শোনা যায়, যা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলো পর্যন্ত পৌঁছে যায়।

ধারণা করা হচ্ছে, এই সংঘর্ষটি মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বিদ্রোহী গোষ্ঠী কিংবা রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠন আরসা বা আরএসও-এর মধ্যে ঘটেছে। গোলাগুলির শব্দে তুমব্রু, বাইশফারি এবং আশপাশের গ্রামগুলোর বাসিন্দারা রাতভর ভয়ে আতঙ্কে সময় কাটিয়েছেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, সংঘর্ষের স্থানটি ৩৪ ও ৩৫ নম্বর সীমান্ত পিলারের মাঝামাঝি এলাকায়, মিয়ানমারের ভেতরে প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ মিটার দূরে অবস্থিত। রাতভর চলা এই গোলাগুলিতে গুলির শব্দ এতটাই তীব্র ছিল যে, সীমান্তপারের বাসিন্দারা মনে করেন, সংঘর্ষ তাদের কাছেই ঘটছে। এ ধরনের পরিস্থিতি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে নিয়মিত হয়ে উঠেছে। ১০ অক্টোবর রাতেও উখিয়া ও ঘুমধুম সীমান্তে প্রায় তিন ঘণ্টাব্যাপী গোলাগুলি চলে। একইভাবে ১১ অক্টোবর রাতে বাইশফারি সীমান্তে ৩৬ নম্বর পিলারের কাছে অনুরূপ সংঘর্ষ হয়, যা রাত ৭টার পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত স্থায়ী হয়।

স্থানীয়রা বলছেন, এসব সংঘর্ষের কারণে তারা এখন প্রায় প্রতিরাতেই আতঙ্কে থাকেন। ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু এলাকার বাসিন্দা আবদুল করিম বলেন, “রাতে হঠাৎ প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ শুনে সবাই ভয় পেয়ে যায়। শিশুরা কাঁদতে শুরু করে। আমরা লাইট বন্ধ করে ঘরে বসে ছিলাম, কেউ বাইরে যেতে সাহস পাইনি।” অনেক পরিবার নিরাপত্তার জন্য আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে চলে যাচ্ছেন। সীমান্তে বসবাসরত মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে এবং রাতের ঘুমও হারাম হয়ে গেছে।

এই পরিস্থিতিতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সীমান্তে টহল জোরদার করেছে। ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস. এম. খায়রুল আলম বলেন, “বিজিবি সীমান্তে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত টহল ও নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। আমরা ঘনিষ্ঠভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি।” তিনি সীমান্তবাসীদের আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “জনগণকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে, তবে তারা যেন অযথা সীমান্তের খুব কাছাকাছি না যায়।” বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে এবং স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা হচ্ছে।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক সময়ে সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘর্ষ নতুন করে তীব্র আকার ধারণ করেছে। এসব সংঘর্ষের প্রভাব বাংলাদেশ সীমান্তেও পড়ছে। সীমান্তজুড়ে মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) কয়েকটি ক্যাম্প থেকে নিয়মিত গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই লড়াইয়ে আরাকান আর্মি, আরসা ও আরএসও’র মতো গোষ্ঠীগুলোর সম্পৃক্ততা রয়েছে।

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ২৭১ কিলোমিটার দীর্ঘ, যার একটি বড় অংশ পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকায় অবস্থিত। এই অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বলে পরিচিত। সাম্প্রতিক সংঘর্ষে নিরাপত্তা পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠেছে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।

স্থানীয় প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনী জানিয়েছে, সীমান্ত পরিস্থিতি নজরদারিতে রয়েছে এবং প্রয়োজনে অতিরিক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। একইসঙ্গে সরকার কূটনৈতিক পর্যায়েও মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে, যাতে সীমান্তের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।