বান্দরবানে যৌথ অভিযান: ৬ সশস্ত্র সদস্য আটক

থানচি ও আলীকদমে যৌথ অভিযান: গোয়েন্দা তথ্যের জালে আটকে ৬ সশস্ত্র সদস্য, অস্ত্র-গোলাবারুদের বিপুল উদ্ধার।

বান্দরবান থেকে অসীম রায় (অশ্বিনী): পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার থানচি ও আলীকদম উপজেলায় সেনাবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষী বাংলাদেশ (বিজিবি)-এর যৌথ অভিযানে অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান চক্রের সঙ্গে জড়িত ৬ জন সশস্ত্র সদস্যকে আটক করা হয়েছে। অভিযানে পিস্তল, বন্দুক, হ্যান্ড গ্রেনেড, ম্যাগাজিন, গোলাবারুদসহ বিভিন্ন সামরিক সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে।

এই অভিযানগুলো সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়েছে, যা অঞ্চলের স্থিতিশীলতা ও সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সেনাবাহিনী ও বিজিবির অব্যাহত তৎপরতার অংশ।

পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে অবৈধ অস্ত্র চোরাচালান ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর কার্যকলাপ দীর্ঘদিনের সমস্যা। ২০২২ সাল থেকে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)-এর মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই অঞ্চলে যৌথ অভিযানগুলো তীব্রতর হয়েছে, যাতে স্থানীয় জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনা যায়। গত কয়েক মাসে সেনাবাহিনী ও বিজিবির অভিযানে শতাধিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে, যা অঞ্চলের নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করেছে।

থানচিতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে প্রথম ধাপের অভিযান

গত ১৮ অক্টোবর (শনিবার) পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলায় সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বলিপাড়া বিজিবি জোনের একটি অভিযানিক দল অবৈধ অস্ত্র চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে তল্লাশি অভিযান শুরু করে। অভিযানের সময় টহলদল অস্ত্র চোরাচালান চক্রের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ওয়াইবার ত্রিপুরা (৩৩) নামক এক ব্যক্তিকে আটক করে। ত্রিপুরা থানচি উপজেলার বাসিন্দা এবং স্থানীয়ভাবে অস্ত্র ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বলে পরিচিত।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ত্রিপুরার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সেনাবাহিনী ও বিজিবির যৌথ দল পরদিনই থানচি উপজেলার রেমাক্রি ইউনিয়নের লিক্রি এলাকায় অভিযান চালায়। এই অভিযানে ত্রিপুরার সহযোগী রোহান ম্রো (৬০) নামক আরেক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। ম্রোর বাড়ি তল্লাশি করে যৌথ বাহিনী নিম্নলিখিত অস্ত্র ও সরঞ্জাম উদ্ধার করে:

তালিকাভুক্ত সামগ্রীসমূহের মধ্যে রয়েছে এমজি বল অ্যামুনিশন (রাউন্ড) মোট ২৮টি, ওয়াকিটকি সেট ২টি এবং ওয়াকিটকি চার্জার ৪টি। উপরোক্ত আনুষঙ্গিক সামগ্রীর সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের সামরিক যন্ত্রপাতিও তালিকাভুক্ত আছে, তবে সেগুলোর পরিমাণ স্পষ্ট করা হয়নি।

আটককৃতদের থানচি থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বিজিবির সূত্র জানায়, এই চক্রটি মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে অস্ত্র চোরাই করে আনতো এবং স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে বিতরণ করতো। এই অভিযানে বিজিবির ৩৮ নং বলিপাড়া ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. আব্দুল্লাহ-ইল আহাদের নেতৃত্বে টাস্ক ফোর্স গঠিত হয়েছিল।

আলীকদমে দ্বিতীয় ধাপ

১৯ অক্টোবর, রবিবার সকালে বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার আগলা পাড়া এলাকায় সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ অভিযানিক দল তল্লাশি অভিযান চালায়। অভিযানে মেনশন ম্রো নামক এক ব্যক্তির বাড়ি ঘিরে ফেলা হয়। তবে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে সশস্ত্র সদস্যরা ঘটনাস্থল থেকে পলায়ন করে।

পরবর্তীতে এলাকায় তীব্র তল্লাশি চালিয়ে সেনা ৪ জন সন্দেহজনক ব্যক্তিকে আটক করে। আটককৃতদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় নিম্নলিখিত সামগ্রী:

আলীকদম উপজেলা বান্দরবানের দক্ষিণাংশে অবস্থিত এবং এর আয়তন প্রায় ৮৮৬ বর্গকিলোমিটার, যা মিয়ানমার সীমান্তের কাছাকাছি। এই অঞ্চলে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির ও সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রভাব রয়েছে, যা অস্ত্র চোরাচালানকে সহজ করে। সেনাবাহিনীর সূত্র জানায়, আটককৃতরা কেএনএফ-সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং তারা সীমান্ত পার হয়ে অস্ত্র আনিয়ে স্থানীয়ভাবে বিক্রি করতো।

পার্বত্য চট্টগ্রাম (সিএইটি) বাংলাদেশের একটি সংবেদনশীল অঞ্চল, যেখানে ১১টি উপজেলা রয়েছে এবং বৌদ্ধ, হিন্দু ও খ্রিস্টান জাতিগোষ্ঠী (চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, ম্রো, বাউম ইত্যাদি) বাস করে। ১৯৯৭ সালের শান্তি চুক্তির পরও এখানে সশস্ত্র গোষ্ঠীর কার্যকলাপ অব্যাহত রয়েছে। কেএনএফ-এর মতো গোষ্ঠীগুলো রাঙামাটি ও বান্দরবানের নয়টি উপজেলায় স্বায়ত্তশাসিত রাজ্য দাবি করে, যা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই অঞ্চলে ব্যাংক ডাকাতি, অপহরণ ও নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলার ঘটনা বেড়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের এপ্রিলে থানচি ও রুমায় দুটি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় কেএনএফ-এর সদস্যরা জড়িত ছিল, যাতে লক্ষ লক্ষ টাকা লুট হয় এবং একজন ব্যাংক ম্যানেজার অপহৃত হয়। এর ফলে সেনাবাহিনী ও বিজিবির যৌথ অভিযান তীব্রতর হয়েছে। গত জুন মাসে বান্দরবানে সশস্ত্র সংগঠনের ৯ জনকে অস্ত্রসহ আটক করা হয়েছে, যা চাঁদাবাজি ও অপহরণের সঙ্গে যুক্ত ছিল।

স্থানীয় বাসিন্দারা এই অভিযানগুলোকে স্বাগত জানিয়েছেন। থানচি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. মামুন জানান, “এই অভিযানগুলো আমাদের অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনবে। সাধারণ মানুষ এখন নিরাপদে বাজার-ব্যবসা করতে পারছেন।” তবে কিছু জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা অভিযানের সময় নিরপরাধ মানুষের উপর অতিরিক্ত চাপ না পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

সেনাবাহিনী ও বিজিবির অঙ্গীকার

পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সশস্ত্র সদস্যদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ও বিজিবির যৌথ অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সেনাবাহিনীর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং এ অঞ্চলের সকল জাতিগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় যেকোনো পদক্ষেপ গ্রহণে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

বিজিবির জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, “গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করে আমরা এই চক্রগুলোকে ধ্বংস করব। স্থানীয়দের সহযোগিতা চাই।”

এই অভিযানগুলোর ফলে অঞ্চলের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ স্বাভাবিক হচ্ছে। তবে কর্তৃপক্ষ সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে কোনো নতুন হুমকি না দেখা দেয়। স্থানীয় সাংবাদিক সুজন ভট্টাচার্য্য জানান, “এই অভিযানগুলো শুধু অস্ত্র উদ্ধার নয়, বরং জাতিগত ঐক্য ও উন্নয়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।”

(সম্পাদকীয় সহযোগিতায় স্থানীয় সূত্র ও বিজিবি-সেনাবাহিনীর তথ্যভিত্তিক)