একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে আতঙ্ক: অবহেলা নাকি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র?

অক্টোবরে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে কাঁপছে বাংলাদেশ: নাশকতা নাকি অবহেলা—তদন্তে সরকার।

টুইট প্রতিবেদন: অক্টোবরের শুরু থেকে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডে কেঁপে উঠেছে বাংলাদেশ। খুলনা থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম থেকে বিমানবন্দর—দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া আগুন ও বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো জনমনে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এসব ঘটনাকে “অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ” হিসেবে বিবেচনা করে তদন্তে নামিয়েছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে।

একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জনমনে চরম উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। খুলনা, আশুলিয়া, মিরপুর, চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর—প্রতিটি স্থানে আগুনের ভিন্ন ভিন্ন রূপ, কিন্তু আতঙ্কের ছায়া এক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অক্টোবর মাসের ছয়টি বড় অগ্নিকাণ্ড কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়; বরং এটি একটি অস্বাভাবিক ধারা, যা অবহেলা, শিল্পনিরাপত্তা ঘাটতি কিংবা সম্ভাব্য নাশকতার ইঙ্গিত বহন করছে।

সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহের কালানুক্রমিক বিবরণ

খুলনায় গ্যাস বিস্ফোরণ (১ অক্টোবর ২০২৫)

খুলনা শহরে গ্যাস লাইন বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন আহত হন। প্রাথমিক তদন্তে গ্যাস লিকেজকে কারণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। কোনো মৃত্যুর ঘটনা না ঘটলেও এটি পরবর্তী ঘটনাগুলোর “সতর্কবার্তা” হিসেবে দেখা হচ্ছে।

আশুলিয়ায় বিস্ফোরণ (১১ অক্টোবর ২০২৫)

ঢাকার আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে একটি কারখানায় বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কয়েকজন শ্রমিক আহত হন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে—রাসায়নিক পদার্থের অপব্যবহার থেকেই আগুনের সূত্রপাত।

মিরপুরের পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ড (১৪-১৫ অক্টোবর ২০২৫)

রাজধানীর মিরপুরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু এবং ২০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, গুদামে সংরক্ষিত দাহ্য রাসায়নিক থেকে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ছাদের দরজা বন্ধ থাকায় অনেক শ্রমিক পালাতে পারেননি। এই ঘটনাটি দেশের পোশাক শিল্পে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়গুলোর একটি।

চট্টগ্রাম ইপিজেড কারখানায় অগ্নিকাণ্ড (১৬ অক্টোবর ২০২৫)

চট্টগ্রাম এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনে (ইপিজেড) অবস্থিত একটি কারখানায় আগুন লাগে। শ্রমিকদের দ্রুত সরিয়ে নেওয়ায় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি, তবে সম্পদের ক্ষতি ব্যাপক। প্রাথমিকভাবে ইলেকট্রিক্যাল শর্ট সার্কিটকে কারণ হিসেবে সন্দেহ করা হচ্ছে।

শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো টার্মিনালে অগ্নিকাণ্ড (১৮ অক্টোবর ২০২৫)

দুপুর ২:১৫ মিনিটে বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে বিস্ফোরণসহ আগুন লাগে। ৩৬টি ফায়ার ইউনিট, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর যৌথ প্রচেষ্টায় কয়েক ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। যদিও কোনো প্রাণহানি ঘটেনি, তবু আমদানি এলাকায় কোটি টাকার পণ্য পুড়ে গেছে। বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় শতাধিক ফ্লাইট বিলম্বিত বা অন্যত্র ডাইভার্ট করা হয়। তদন্তে বিস্ফোরণের উৎস ও সম্ভাব্য নাশকতার দিকটি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া

মানবিক দিক: অন্তত ১৬ জনের মৃত্যু ও ৫০-এর বেশি আহত। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো এখনো শোক ও অনিশ্চয়তায়।

অর্থনৈতিক দিক: পোশাক শিল্পে কোটি টাকার ক্ষতি, বিমানবন্দরের আগুনে আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত। বিশেষজ্ঞদের মতে, সাময়িকভাবে সরবরাহ শৃঙ্খল (supply chain) বিপর্যস্ত হতে পারে।

সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া

অগ্নিকাণ্ডগুলো নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে #HybridWarfare এবং #IndiaOut হ্যাশট্যাগে আলোচনার ঝড় বইছে। কিছু ব্যবহারকারী ভারতের সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত দিয়েছেন, যদিও সরকারি কোনো সূত্র তা নিশ্চিত করেনি।

অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতি (১৮ অক্টোবর)

সরকার বলেছে, “নিরাপত্তা সংস্থাগুলো প্রতিটি ঘটনা গভীরভাবে তদন্ত করছে। যদি কোনো নাশকতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” সরকার নাগরিকদের শান্ত ও সংযমী থাকার আহ্বান জানিয়েছে।

বিএনপির প্রতিক্রিয়া

অ্যাক্টিং চেয়ারম্যান তারিক রহমান বিমানবন্দরের আগুনে উদ্বেগ প্রকাশ করে স্বাধীন তদন্তের দাবি জানিয়েছেন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সামরিক বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও ঘটনাগুলোর পেছনের কারণ উদঘাটনে “স্বচ্ছ তদন্তের” আহ্বান জানিয়েছেন।

তদন্তের অগ্রগতি

পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে তদন্ত করছে। মিরপুরের ঘটনার ক্ষেত্রে প্রাথমিক প্রতিবেদন negligence বা অবহেলাকে দায়ী করছে। তবে বিমানবন্দরের বিস্ফোরণ নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি।

বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এই অগ্নিকাণ্ডসমূহ শুধু শিল্পনিরাপত্তার দুর্বলতাই নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার ঝুঁকিও সামনে এনেছে। সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ এবং তদন্ত প্রশংসনীয়, তবে জনগণের আস্থা অর্জনে আরও স্বচ্ছতা ও তথ্য প্রকাশ জরুরি।

পরামর্শ

সকল শিল্পাঞ্চলে বাধ্যতামূলক ফায়ার সেফটি অডিট বাস্তবায়ন।

শ্রমিক ও সাধারণ নাগরিকদের গ্যাস ও অগ্নি নিরাপত্তা প্রশিক্ষণ।

সন্দেহজনক কর্মকাণ্ড তাৎক্ষণিকভাবে কর্তৃপক্ষকে জানানো।

জনমনে আতঙ্ক না ছড়িয়ে ঐক্য ও সংযম বজায় রাখা।

বাংলাদেশ অতীতেও বহু সঙ্কট অতিক্রম করেছে। এই কঠিন সময়েও ঐক্য, সতর্কতা ও সচেতনতার মধ্য দিয়েই দেশ আগুনের এই দুঃসময় পার করবে।