সংসদভবনের সামনে সংঘর্ষে জুলাই যোদ্ধার কৃত্রিম হাত, আহত ২০

সংসদ ভবনের সামনে জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিবাদ: লাঠিচার্জে কৃত্রিম হাত খুলে পড়ে যায়, সংঘর্ষে আহত প্রায় ২০ জন।

টুইট প্রতি‌বেদন: জুলাই মাসের ঐতিহাসিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত আহত ব্যক্তিরা শুক্রবার (১৭ অক্টোবর) ‘জুলাই সনদ’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে জাতীয় সংসদ ভবন এলাকায় প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। এসময় উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে, যাতে বেশ কয়েকজন আহত হন।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, একজন জুলাই যোদ্ধার কৃত্রিম হাত লাঠিচার্জের ধাক্কায় খুলে রাস্তায় পড়ে থাকা—যার ভিডিও এবং ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনা নিয়ে অনলাইন-অফলাইনে তীব্র আলোচনা-সমালোচনা চলছে, যা পুলিশি অত্যাচার এবং আন্দোলনকারীদের প্রতি রাষ্ট্রের নির্লিপ্ততার প্রতীক হিসেবে দেখা হচ্ছে।

কীভাবে শুরু হলো সংঘর্ষ?

শুক্রবার দুপুর ২টার দিকে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জুলাই যোদ্ধারা জড়ো হন। তারা ‘জুলাই সনদ’ নামে একটি দলিলে স্বাক্ষর করার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, যা ২০২৪ সালের জুলাই মাসের কোটা সংস্কার আন্দোলনের স্মৃতি ও দাবির স্বীকৃতি হিসেবে তৈরি। এই আন্দোলনে শত শত যুবক-যুবতী আহত হয়েছিলেন, যাদের মধ্যে কেউ কেউ স্থায়ী শারীরিক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। জুলাই যোদ্ধারা এই সনদের মাধ্যমে সরকারের কাছে তাদের দাবি ও স্মৃতির স্বীকৃতি চেয়েছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে আন্দোলনের সময় হত্যা, আহত ও অবিচারের পূর্ণ বিচার এবং ক্ষতিপূরণ।

তবে সংসদ ভবন এলাকায় পৌঁছানোর পর পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের প্রবেশে বাধা দেয়। জুলাই যোদ্ধারা গেট খোলার দাবিতে অবস্থান করলে পুলিশ লাঠিচার্জ শুরু করে। এতে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে—জুলাই যোদ্ধারা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন এবং কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করেন। সংসদ ভবনের গেট বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে তারা ভিতরে প্রবেশ করতে না পারেন। সংঘর্ষের ফলে সংসদ ভবন এলাকায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে এবং আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশ অতিরিক্ত বাহিনী নিয়ে আসে।

আহতের তথ্য: ঢামেকে ভর্তি ২০ জন, কেউ গুরুতর নয়
সংঘর্ষে আহত হন ২০ জন জুলাই যোদ্ধা। তারা সবাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, কারো অবস্থা গুরুতর নয়, তবে লাঠির আঘাতে মাথা, হাত-পায়ে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এছাড়া, সংঘর্ষের সময় জুলাই যোদ্ধারা কয়েকটি যানবাহন ভাঙচুর করে এবং আগুনও জ্বালানো হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে।

কৃত্রিম হাতের ঘটনা: আতিকুল ইসলামের বক্তব্য যা হৃদয় ছুঁয়ে গেছে

সংঘর্ষের মধ্যে সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে আতিকুল ইসলামের (পরিচিতি: আতিকুল গাজী) সাথে। লাঠিচার্জের সময় তার শরীরে লাগানো কৃত্রিম হাত খুলে রাস্তায় পড়ে যায়। এই দৃশ্যের ভিডিও এবং ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়, যা লক্ষ লক্ষ মানুষ দেখেছেন।

আতিকুলের বক্তব্য: “আমার একটা হাত নাই, আর্টিফিশিয়াল হাত, এটাও ওরা বাড়ি মেরে ভেঙে দিল।” তিনি পূর্বে জুলাই আন্দোলনে আহত হয়ে পঙ্গু হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হাত কাটিয়ে ফেলেছিলেন। পরবর্তীতে ব্র্যাক থেকে কৃত্রিম হাত লাগানো হয়, যা তিনি এখন ব্যবহার করেন। আতিকুল বলেন, “আজকে এ প্রতিবাদ জানাতে সংসদ ভবন এলাকাতে এসে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের লাঠির আঘাতে এ হাতটিও ভেঙে পড়ল।” এই ঘটনা জুলাই যোদ্ধাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে এবং অনেকে এটাকে ‘প্রতীকী অত্যাচার’ বলে অভিহিত করছেন।

অনলাইন-অফলাইন আলোচনা: সমালোচনার ঝড়
ঘটনার ভিডিও এবং ছবি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় #JulyWarrior #ArtificialHand #PoliceBrutality এর মতো হ্যাশট্যাগ ট্রেন্ড করছে। ফেসবুক, টুইটার (এক্স) এবং টিকটকে হাজার হাজার পোস্ট হয়েছে, যেখানে পুলিশের নির্যাতন এবং সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ পাচ্ছে। একজন নেটকর্মী লিখেছেন, “একটা হাত কেটে ফেলা যোদ্ধার আরেকটা কৃত্রিম হাতও রাষ্ট্র ভেঙে দিল—এ কোন দেশ?” অফলাইনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্ররা প্রতিবাদ সभा করে সমর্থন জানিয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এটাকে ‘রাষ্ট্রীয় সহিংসতা’ বলে অভিহিত করেছে, যখন সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য আসেনি। এই আলোচনা জুলাই আন্দোলনের স্মৃতিকে পুনরায় জাগিয়ে তুলেছে এবং নতুন করে প্রতিবাদের ঢেউ সৃষ্টি করতে পারে।

ব্যাকগ্রাউন্ড: জুলাই আন্দোলনের ‘যোদ্ধা’রা কারা?

২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি টার্নিং পয়েন্ট হয়ে ওঠে। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শুরু হওয়া এই আন্দোলন পুলিশি দমনমূলক হামলায় রক্তাক্ত হয়, যাতে শত শত যুবক আহত ও নিহত হন। এই আহতদের ‘জুলাই যোদ্ধা’ বলে অভিহিত করা হয়। তারা বর্তমান অন্তর্বর্তীকারী সরকারের কাছে বিচার, ক্ষতিপূরণ এবং স্মৃতি স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছেন। এই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান ছিল তাদের সেই দাবির একটি অংশ।

প্রতিবাদের প্রতীক হলো কৃত্রিম হাত

এই ঘটনা শুধু একটি সংঘর্ষ নয়, বরং জুলাই যোদ্ধাদের অদম্য সংগ্রামের প্রতীক। আতিকুলের কৃত্রিম হাত রাস্তায় পড়ে থাকা ছবিটি যেন বলছে—রাষ্ট্র যতই চাপ দিক, আন্দোলনের আত্মা ভাঙবে না। সরকারের পক্ষ থেকে যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে এই আলোচনা আরও বড় আন্দোলনে রূপ নিতে পারে।

জুলাই যোদ্ধাদের দাবি মেনে নিয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনাই এখন প্রয়োজন।