ইলিশের চাপ রুই-কাতলার বাজারে, গরু-মুরগিতেও নেই স্বস্তি

টুইট ডেস্ক: ইলিশ ধরায় সরকারি নিষেধাজ্ঞা শুরু হওয়ার পর থেকেই রাজধানীর বাজারে দেখা দিয়েছে মাছের টানাপোড়েন। গত দুই সপ্তাহ ধরে সরবরাহ কমে যাওয়ায় রুই, কাতলা, চিংড়ি, ট্যাংরা থেকে শুরু করে ছোট মাছ- সব কিছুর দাম বেড়েছে কেজি প্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত। এদিকে গত কয়েক মাস যাবৎ মধ্য-নিম্নবিত্তদের জন্য গরু-মুরগির বাজারেও স্বস্তির দেখা নেই। সবকিছুর দাম এখন ক্রেতার নাগালের বাইরে।

শুক্রবার (১০ অক্টোবর) রাজধানীর রামপুরা ও বনশ্রী এলাকার বাজার ঘুরে ও বাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, আজকের বাজারে ইলিশ বিক্রেতাদের দেখা মেলেনি। অন্যদিকে কাচকি, ট্যাংরা, চিংড়ি, বাতাসি, পাবদা- সব ধরনের মাছের দাম বেড়েছে আগের তুলনায়। কাচকি মাছ বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায়, ট্যাংরা, কাজলি, চিংড়ি ও বাতাসি মাছ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ১,০০০ টাকায়।

চাষের রুই ও কাতলা মাছ আকারভেদে বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকায়, পাবদা ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়। পাঙাশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ২২০ থেকে ২৫০ টাকায়, তেলাপিয়া ও সিলভার কার্প ২২০ থেকে ২৬০ টাকায়। ছোট আকারের তেলাপিয়া ১৮০ থেকে ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ইলিশ না থাকায় অন্য মাছের ওপর চাপ

সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী- ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ইলিশ ধরা ও বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ। এতে শুধু ইলিশ নয়, নদীতে জেলেরা অন্য মাছ ধরতেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন। যার কারণে বাজারে মাছের আমদানি কমে গিয়ে সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে।

বিক্রেতাদের মতে, ইলিশ ধরা বন্ধ থাকায় বাজারে মাছের সরবরাহ কমে গেছে। ফলে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় অন্য মাছের দাম কিছুটা বাড়ছে। রামপুরা বাজারের মাছ বিক্রেতা হান্নান মিয়া বলেন, ‘ইলিশ বিক্রি বন্ধ, কিন্তু ক্রেতারা মাছ তো চাই-ই। তাই এখন সবাই রুই, ট্যাংরা, পাবদা এসব মাছের দিকে ঝুঁকছেন। ফলে পাইকারিতে দাম বেড়ে গেছে।’

তবে ক্রেতারা বলছেন, দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তারপরও মাছের বাজারে এখন আগের চেয়ে ৩০-৪০ টাকা কেজিতে বেশি দিতে হচ্ছে। মাঝারি আকারের ভালো মাছ কিনতে গেলে ১ হাজার টাকার নিচে ঘরে ফেরা সম্ভব হচ্ছে না। রামপুরা বাজারের ক্রেতা মিজানুর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহেই বাজারে কিছু না কিছু বাড়ে। আজ রুই ৪০০ টাকা, কাল ৪৫০! ইলিশ বন্ধ থাকলেই কি অন্য মাছের দাম বাড়াতে হবে?’

একই বাজারে গৃহিণী রত্না বেগম বলেন, ‘আগে এক কেজি পাবদা কিনতাম, এখন আধা কেজি কিনি। ট্যাংরা মাছের দাম এত বেড়ে যাবে, ভাবিনি। এখন বাজারে ঢুকলেই ভয় লাগে- কী কিনব, কী ছাড়ব বুঝি না।’

ডিমও বাড়তি, প্রোটিনে চাপ

মাছ-মাংসের দাম বাড়ায় অনেকেই এখন বিকল্প হিসেবে ডিমের ওপর নির্ভর করছেন। কিন্তু প্রোটিনের এই ‘সহজ বিকল্প’-এর দামও বেড়েছে। রাজধানীর বাজারে এখন লাল ডিম ডজন প্রতি ১৪০ থেকে ১৪৫ টাকা, সাদা ডিম ১৩৫ টাকা। প্যাকেটজাত ডিমের দাম আরও বেশি– ডজন প্রতি ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

রামপুরা বাজারের বিক্রেতা মো. কামাল বলেন, ‘সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দাম বেড়েছে ১০ টাকা। বৃষ্টির কারণে সবজির দাম বেড়েছে, ফলে অনেকে ডিমের দিকে ঝুঁকছেন। তাতেই চাপ পড়েছে বাজারে।’

বনশ্রী এলাকার ডিম ব্যবসায়ী আমানত উল্লাহ বলেন, ‘গত দুই-তিন সপ্তাহে চাহিদা বেড়েছে। তবে সরবরাহ ঠিক থাকলে দুই-তিন দিনের মধ্যে দাম কিছুটা কমে আসবে।’

মুরগির বাজারেও স্থিতি নেই

মাছের পাশাপাশি মুরগির দামও বেড়েছে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১৫ টাকা। ব্রয়লার বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়, যা গত সপ্তাহে ছিল ১৬৫ থেকে ১৭০ টাকা। সোনালি মুরগি ২৯০ থেকে ৩০০, আর দেশি মুরগি ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

বনশ্রী বাজারের ক্রেতা আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, ‘ব্রয়লার ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায় বিক্রি হলে ব্যবসায়ীরা তখনও লাভ করত। বছরের শুরুতে তো ওই দামেই বিক্রি হয়েছে। এখন হঠাৎ করে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা কেজি কেন? এই বৃদ্ধির যৌক্তিকতা নেই।

বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম অবশ্য ভিন্ন যুক্তি দেন। তিনি বলেন, ‘খামারিদের কাছ থেকেই আমরা বেশি দামে কিনছি। ফিড, পরিবহন আর বিদ্যুতের খরচ বেড়েছে, তাই পাইকারি বাজারেই দাম বাড়ছে। আমাদের কিছু করার নেই।’

গরুর মাংস অপরিবর্তিত

রাজধানীর বাজারে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে কেজিপ্রতি ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকায়, খাসি ১ হাজার ১০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়, আর বকরি ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকায়। দাম অপরিবর্তিত থাকলেও ক্রেতারা বলছেন, অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের সঙ্গে মিলিয়ে এখন এসবও ‘বিলাসিতা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাজারে আসা চাকরিজীবী সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ইলিশ তো একেবারেই নেই, অন্য মাছের দামেও আগুন। ডিম-ডালও আর সস্তা নেই। গরুর মাংস তো খাওয়া ছেড়েই দিছি। সংসারের বাজেট এখন সম্পূর্ণ গুলিয়ে গেছে।’

বনশ্রী বাজারের মাংস বিক্রেতা আবদুল হালিম বলেন, ‘গরুর মাংসের দাম আগের মতোই, তবে খাসি ও দেশি মুরগির দাম কিছুটা বেড়েছে। খামারিরা ফিড ও পরিবহন খরচ বাড়ার কথা বলে পাইকারিতে দাম বাড়াচ্ছেন।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিশে সরকারি নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হওয়ায় বাজারে সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ফলে বিকল্প মাছের দামও বেড়েছে। অন্যদিকে গরু-মুরগির দামও অপরিবর্তিত থেকে চাপে রেখেছে ক্রেতাদের। প্রোটিনের সব উৎসই যখন ক্রেতার নাগালের বাইরে– তখন মধ্যবিত্তের একটাই প্রশ্ন: এই বাজারে টিকে থাকা যাবে কেমন করে?