আওয়ামী লীগের লুটের দায় কেন বিনিয়োগকারীদের ঘাড়ে?
পাঁচ ব্যাংকের একীভূতকরণে শেয়ারহোল্ডারদের অনিশ্চয়তা ও নিয়ন্ত্রকের হস্তক্ষেপ।
টুইট প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংকিং খাতে চরম দুর্নীতি, অনিয়মমূলক ঋণ বিতরণ এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় জড়িয়ে পাঁচটি শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। এই ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৭০% থেকে ৯০% পর্যন্ত, যা আমানতকারীদের অর্থ ফেরতের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে ব্যাংক খাত সংস্কারের অংশ হিসেবে ২০২৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পাঁচটি ব্যাংক—ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংক—একীভূত করে একটি নতুন শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি ব্যাংকিং খাতে সুশাসন ফিরিয়ে আনার একটি বড় উদ্যোগ হলেও, প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ বিনিয়োগকারী ও শেয়ারহোল্ডারদের ভাগ্য নিয়ে।
দুর্নীতির দায় যেন ব্যাংকের উদ্যোক্তা-পরিচালকদের পরিবর্তে পড়ছে বছরের পর বছর শেয়ার কিনে ব্যাংকগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এমন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঘাড়ে। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) এই প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে, কিন্তু এখনও স্পষ্ট নির্দেশনা আসেনি।
আওয়ামী লীগ আমলে ব্যাংকগুলোর লুটপাট ও বিপর্যয়
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে (২০০৯-২০২৪) ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক প্রভাব, অনিয়মমূলক ঋণ বিতরণ এবং ইনসাইডার লেনদেনের ফলে এই পাঁচটি ব্যাংক চরম সংকটে পড়ে। এগুলোর মধ্যে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক (এস আলম গ্রুপ), এক্সিম ব্যাংক (সিকদার গ্রুপ), ইউনিয়ন ব্যাংক (নাসা গ্রুপ) এবং অন্যান্যের সঙ্গে যুক্ত রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছিল মূল কারণ। খেলাপি ঋণের (NPL) হার এতটাই বেড়ে যায় যে ব্যাংকগুলোর নেট সম্পদমূল্য ঋণাত্মক হয়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, একীভূত হওয়ার সময় এই ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৭৭% খেলাপি ছিল, যা সমগ্র ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলে।
এই ব্যাংকগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত, এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বছরের পর বছর শেয়ার কিনে এদের সমর্থন করে এসেছেন। কিন্তু দুর্নীতির ফলে ব্যাংকগুলোর শেয়ার মূল্য ১০ টাকা ফেস ভ্যালুর থেকে ৭০-৮৫% কমে গেছে। ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শেয়ার মূল্য ছিল: ফার্স্ট সিকিউরিটি ১.৯ টাকা, গ্লোবাল ১.৫ টাকা, ইউনিয়ন ১.৬ টাকা, সোশ্যাল ৩.৩ টাকা, এক্সিম ২.৯ টাকা। ফলে বিনিয়োগকারীরা ইতিমধ্যে বিপুল ক্ষতির মুখে পড়েছেন। গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক সংস্কার শুরু করে, যার ফলে এই একীভূতকরণের সিদ্ধান্ত হয়।
একীভূতকরণ প্রক্রিয়া: কী হবে নতুন ব্যাংকে?
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৬ সেপ্টেম্বরের সিদ্ধান্ত অনুসারে, এই পাঁচ ব্যাংক একীভূত হয়ে ‘ইউনাইটেড ইসলামী ব্যাংক’ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক গঠন করবে। এতে ৭৭৯টি শাখা, ৬৯৮টি সাব-ব্রাঞ্চ, ১০০০টি এটিএম এবং ১৬,০০০ কর্মী থাকবে। সরকার ২৫,০০০ কোটি টাকা ক্যাপিটাল ইনজেকশন দেবে, যা ৩৫,০০০ কোটি টাকার প্রভিজনিং ঘাটতির অংশ মেটাবে। বাকি অর্থ উন্নয়ন সহযোগী, বীমা তহবিল এবং আন্তর্জাতিক ঋণদাতা (ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ) থেকে আসতে পারে।
প্রক্রিয়া ব্যাংক রেজোলিউশন অর্ডিন্যান্স, ২০২৫-এর অধীনে চলছে, যা আমানতকারীদের পুরোপুরি সুরক্ষা নিশ্চিত করে। কিন্তু শেয়ারহোল্ডারদের জন্য অনিশ্চয়তা: অর্ডিন্যান্সের ধারা ৭৭-এ দোষী (স্পনসর, পরিচালক) চিহ্নিত হয়েছে, কিন্তু সাধারণ শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার ক্যান্সেল হতে পারে এবং নতুন ব্যাংকে কোনো শেয়ার না পেয়ে কোনো কমপেনসেশন না পাওয়ার আশঙ্কা। নতুন ব্যাংক পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে, কিন্তু নতুন শেয়ার ইস্যু হবে। এতে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের বিপরীতে ‘কিছুই’ না পাওয়ার ঝুঁকিতে।
বিনিয়োগকারীদের উপর দায়: কেন এমন হচ্ছে?
প্রশ্নটা স্পষ্ট—আওয়ামী লীগের আমলে উদ্যোক্তা-পরিচালকদের লুটপাটের দায় কেন সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে?
দোষীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের সীমাবদ্ধতা
অর্ডিন্যান্সের অধীনে দোষীদের (ধারা ৭৭-এ চিহ্নিত) সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে এবং ঋণের কোল্যাটারাল থেকে অর্থ আদায়ের চেষ্টা চলছে। কিন্তু এই অর্থ যথেষ্ট নয়, ফলে ব্যাংকের ঘাটতি মেটাতে রাষ্ট্রীয় ইনজেকশন দরকার, যা শেষ পর্যন্ত ব্যাংকের ভাগ্যের উপর পড়ে—যা বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি করে।
শেয়ারহোল্ডারদের অগ্রাধিকারের অভাব
একীভূতকরণে আমানতকারীদের স্বার্থ প্রাধান্য পাচ্ছে, কিন্তু বিনিয়োগকারীদের জন্য কোনো স্পষ্ট প্রতিরক্ষা নেই। ফলে শেয়ার মূল্য আরও কমছে, ক্রেতার সংকট দেখা দিচ্ছে। বিনিয়োগকারীরা বিক্রি করলে ৮০% লস, ধরে রাখলে নতুন ব্যাংকের স্থিতিশীলতার উপর নির্ভরশীল।
প্রক্রিয়াগত জটিলতা
আইটি ইন্টিগ্রেশন, কর্মী-সংস্কৃতির মিলন এবং শরিয়াহ গভর্ন্যান্সের সমস্যা একীভূতকরণকে জটিল করে তুলছে। এতে ব্যাংকের লাভজনকতা দূরের কথা, যা ডিভিডেন্ড বা শেয়ার মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।
বিএসইসি-এর চিঠি: বিনিয়োগকারী রক্ষার দাবি
পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক বিএসইসি ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য জরুরি ব্যবস্থা দাবি করে। চিঠিতে বলা হয়েছে, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকগুলোর বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী নয়; দায় দোষী উদ্যোক্তা-পরিচালকদের। তাই তাদের শেয়ার কনফিস্কেট করা যাবে না, এবং আইনি অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
বিএসইসি-এর নির্দিষ্ট প্রস্তাব
অতিরিক্ত মূল্যায়ন: ব্যাংকের ব্যালেন্স শীটের সম্পদ ছাড়াও লাইসেন্স, শাখা নেটওয়ার্ক, ক্লায়েন্ট বেস, কর্মীসম্পদ, সার্ভিস ডেলিভারি এবং ব্র্যান্ড ভ্যালুর মূল্যায়ন করে বিক্রয়মূল্য নির্ধারণ।
কোল্যাটারাল ও বাজেয়াপ্তি: ঋণের বিরুদ্ধে রিজার্ভ কর্ল্যাটারাল এবং দোষীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে আদায়যোগ্য অর্থ বিবেচনা।
মার্জার রেশিও; দোষীদের শেয়ার বাদ দিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের ন্যূনতম মূল্যের ভিত্তিতে রেশিও নির্ধারণ।
ডিলিস্টিং নিষিদ্ধ; মূল্যায়ন বা অধিগ্রহণ মূল্য ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে পুঁজিবাজার থেকে বাদ দেওয়া যাবে না।
বিএসইসি-এর পরিচালক এবং মুখপাত্র এম এবুল কালাম নিশ্চিত করেছেন যে চিঠিতে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষার পদ্ধতি বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। এটি ব্যাংকিং ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রকের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব পূরণের প্রথম পদক্ষেপ।
দোষীদের শাস্তি ছাড়া সংস্কার অসম্পূর্ণ
একীভূতকরণ ব্যাংকিং খাতকে স্থিতিশীল করতে পারে, কিন্তু বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি না হলে এটি সফল হবে না। আওয়ামী লীগের আমলে লুটের দায় দোষীদের সম্পত্তি থেকে পুরোপুরি আদায় না করে বিনিয়োগকারীদের উপর চাপানো অন্যায়।
বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা বাড়ানো, পেশাদার বোর্ড গঠন, NPL হ্রাসের জন্য আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ এবং শেয়ারহোল্ডারদের জন্য স্বচ্ছতা। বিএসইসি-এর চিঠির পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাড়া এলে পরিস্থিতি স্পষ্ট হবে।
এদিকে, বিনিয়োগকারীরা সতর্কতার সঙ্গে অপেক্ষা করুন এবং নিয়ন্ত্রকের আপডেট অনুসরণ করুন।