পাকিস্তান-আফগান সংঘর্ষে সৌদি-কাতার একসঙ্গে: সীমান্তে শান্তির পক্ষে

কাতারের সতর্কবার্তা: পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে উত্তেজনা নিয়ে সংলাপ ও সংযমের আহ্বান।
টুইট প্রতিবেদক: পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে তীব্র সংঘর্ষ ও উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে কাতার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং উভয় দেশকে সংযম ও সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১১ অক্টোবর এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে জানায়, সীমান্তের সাম্প্রতিক সংঘর্ষ শুধু অঞ্চলীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, বরং দুই প্রতিবেশী মুসলিম দেশের জনগণের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্যও বড় বিপদ।
সীমান্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, উভয় পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি
অক্টোবরের শুরু থেকে পাকিস্তান-আফগান সীমান্তে পরিস্থিতি হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ৯ অক্টোবর ভোরে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী আফগানিস্তানের খোস্ত, পাক্তিকা, কাবুল ও জালালাবাদ অঞ্চলে হামলা চালায়—যেখানে তাদের দাবি, টার্গেট ছিল তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)-এর ঘাঁটি। তবে আফগান তালিবান সরকার এই হামলাকে “সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন” বলে নিন্দা জানায় এবং এটিকে ‘আক্রমণাত্মক কার্যক্রম’ হিসেবে আখ্যা দেয়।
এর পরদিন ১০ অক্টোবর কাবুলে বিস্ফোরণ ঘটে, যা আফগান কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানের বিমান হামলার ফল বলে দাবি করে, যদিও ইসলামাবাদ তা অস্বীকার করেছে।
১১ অক্টোবর রাতে দুরান্দ লাইন বরাবর উভয় পক্ষের মধ্যে প্রবল গোলাগুলি ও সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। আফগান বাহিনী একাধিক পাকিস্তানি পোস্টে হামলা চালায় এবং কয়েকটি সীমান্ত ঘাঁটি দখলের দাবি করে। পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের কর্মকর্তা জান আচাকজাই জানান, “আফগান বাহিনী কোনো উসকানি ছাড়াই হামলা চালিয়েছিল, তবে পাকিস্তানি সেনারা শক্ত প্রতিক্রিয়া জানিয়ে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করে।”
অন্যদিকে আফগান প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র এনায়াত খোয়ারাজম বলেন, এটি ছিল পাকিস্তানের বিমান হামলার ‘প্রতিশোধমূলক’ অভিযান। সংঘর্ষে উভয় পক্ষেই হতাহতের খবর পাওয়া গেছে, তবে আনুষ্ঠানিক সংখ্যা কেউ প্রকাশ করেনি।
কাতারের অবস্থান: কূটনীতির পথে ফেরার আহ্বান
কাতারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “কাতার পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সীমান্তে বাড়তে থাকা সংঘর্ষ ও উত্তেজনা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে। কাতার উভয় পক্ষকে সংলাপ, কূটনীতি এবং সংযম অবলম্বনের আহ্বান জানাচ্ছে, যাতে পরিস্থিতি আরও অবনতি না ঘটে।”
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও জানায়, কাতার অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য সব আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক প্রচেষ্টাকে সমর্থন করে যাবে। এই বিবৃতি শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং মানবিক প্রতিশ্রুতির প্রতিফলনও—কারণ সীমান্ত এলাকায় বসবাসকারী হাজার হাজার সাধারণ মানুষ ইতিমধ্যেই সংঘর্ষের শিকার হচ্ছে।
কাতারের: ঐতিহাসিক মধ্যস্থতাকারী
কাতার বহু বছর ধরে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার শান্তি প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় পরিচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আফগান তালিবানের মধ্যে ২০২০ সালের দোহা চুক্তিও কাতারের উদ্যোগে সম্পন্ন হয়েছিল। এবারও দেশটি দুই প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রকে আলোচনার টেবিলে ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দিচ্ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, দোহা যদি নতুন করে ইসলামাবাদ ও কাবুলের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে, তবে এটি পুরো অঞ্চলের স্থিতিশীলতায় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়া: শান্তি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ আহ্বান
কাতারের মতো সৌদি আরবও সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “আমরা উভয় দেশকে সংযম প্রদর্শনের এবং সংলাপের মাধ্যমে পার্থক্য মেটানোর আহ্বান জানাচ্ছি।”
সৌদির এই প্রতিক্রিয়া, কাতারের বিবৃতির সঙ্গে মিল রেখে, মুসলিম বিশ্বের বৃহৎ দুটি প্রভাবশালী দেশের অভিন্ন অবস্থানকে প্রতিফলিত করে।
আফগান কূটনীতি: নতুন ভারসাম্য খোঁজা
এদিকে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি ১১ অক্টোবর ভারত সফরে গেছেন, যেখানে তিনি অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তা সংলাপ নিয়ে আলোচনা করছেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই সফর আফগানিস্তানের কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার কৌশলের অংশ, যা পাকিস্তানের সঙ্গে বাড়তে থাকা দূরত্বও নির্দেশ করছে।
দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার চ্যালেঞ্জ
পাকিস্তান-আফগান সংঘাত কেবল সীমান্তের নয়; এটি পুরো দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা কাঠামোর জন্য হুমকি হতে পারে। দুরান্দ লাইনের দুই পাশে পশতুন জনগোষ্ঠী বিভক্ত, এবং টিটিপি ও অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের উপস্থিতি অঞ্চলটিকে আরও অস্থির করে তুলেছে।
যদি এই উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে না আনা যায়, তবে তা ভারত, ইরান ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতেও প্রভাব ফেলতে পারে—বিশেষ করে সীমান্ত বাণিজ্য, শরণার্থী সঙ্কট এবং জ্বালানি রুটের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে।
কূটনীতির প্রত্যাবর্তনের প্রয়োজন
কাতার ও সৌদির আহ্বান প্রমাণ করে যে, মুসলিম বিশ্ব সংঘাতের পরিবর্তে সংলাপের মাধ্যমে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার পক্ষে। তবে ইসলামাবাদ ও কাবুলের পারস্পরিক সন্দেহ, সন্ত্রাসবাদ ও সীমান্ত রাজনীতির জটিলতা এই পথে প্রধান বাধা।
বিশ্লেষকদের মতে, যদি জাতিসংঘ বা কাতারের নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ সংলাপ শুরু করা যায়, তবে উত্তেজনা প্রশমিত হওয়া সম্ভব।
তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—পাকিস্তান ও আফগানিস্তান কি ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে শান্তির পথ বেছে নেবে, নাকি সংঘর্ষের দুঃস্বপ্ন আবারও ফিরে আসবে?








