সেনাবাহিনীর দৃঢ় বার্তা: ন্যায়বিচারে আপসহীন

আইসিটি-১-এর অভিযোগে সেনা কর্মকর্তাদের হেফাজত: মেজর জেনারেল কবির নিখোঁজ, আর্মির দৃঢ় অবস্থান ও দেশে-বিদেশে প্রতিক্রিয়ার ঝড়।

টুইট প্রতিবেদন: বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ (আইসিটি-১) কর্তৃক মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২৫ জন সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনায় দেশের সামরিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। এই ২৫ জনের মধ্যে ১৫ জন সার্ভিং অফিসারকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে হেফাজতে নিয়েছে, যা দেশের সামরিক ইতিহাসে এক নজিরবিহীন পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

তবে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন মেজর জেনারেল কবির আহমেদ, যিনি পরোয়ানা জারির পর থেকেই নিখোঁজ বলে জানা গেছে।

গুম, গোপন আটক ও নির্যাতনের মামলা

২০২৫ সালের ৮ অক্টোবর (বুধবার) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ দুটি মামলায় অভিযোগ গ্রহণ করে, যেখানে গুম, গোপন আটক ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তোলা হয়। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন ২৫ জন সেনা কর্মকর্তা (১৫ জন কর্মরত, ৯ জন অবসরপ্রাপ্ত ও ১ জন এলপিআর ছুটিতে)।

অভিযোগগুলোর বেশিরভাগই শেখ হাসিনা সরকারের সময়কাল (২০০৯–২০২৪) জুড়ে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত গুম ও নির্যাতন সংক্রান্ত, যা গুম অনুসন্ধান কমিশনের প্রতিবেদন এবং মানবাধিকার সংস্থার তথ্য থেকে সংগৃহীত।
অভিযুক্তদের মধ্যে অনেকেই পূর্বে ডিজিএফআই (DGFI) ও সিটিআইবি (CTIB)-তে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সেনাসদরের নির্দেশে ১৫ অফিসার হেফাজতে

পরোয়ানা জারির ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সেনাসদর জরুরি নির্দেশ পাঠায় ১৬ জন সার্ভিং অফিসারকে (এলপিআরসহ) রিপোর্ট করতে।

৯ অক্টোবর মধ্যরাতের মধ্যে হাজির হওয়ার সময়সীমা দেওয়া হয়। মেজর জেনারেল কবির আহমেদ ছাড়া বাকি সবাই রিপোর্ট করেন এবং বর্তমানে তাঁরা সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ হেফাজতে আছেন।

তাদের পরিবার ও বাইরের যোগাযোগ আপাতত সীমিত রাখা হয়েছে, যাতে তদন্ত প্রভাবিত না হয়। সেনাসদরের বিবৃতিতে বলা হয়েছে—

“এটি সংবিধান ও সামরিক আইনের আওতায় গৃহীত নিয়মিত প্রক্রিয়া, এবং ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তায় সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ সহযোগিতা করবে।”

অভিযুক্তদের ২২ অক্টোবর আইসিটি-১ ট্রাইব্যুনালে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সেনা সদর জানিয়েছে, যদিও ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক পরোয়ানার কপি এখনও তাদের হাতে আসেনি, তবুও তারা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে।

মেজর জেনারেল কবির আহমেদের নিখোঁজ রহস্য

সবচেয়ে আলোচিত নাম মেজর জেনারেল কবির আহমেদ, যিনি সিটিআইবি-এর সাবেক ডিরেক্টর ছিলেন। ৯ অক্টোবর সকালে তিনি ‘আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি’ বলে বাসা থেকে বের হন এবং তারপর থেকে নিখোঁজ। তাঁর মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে, এবং সর্বশেষ অবস্থান পাওয়া যায় রাজারবাগ এলাকায়।

আর্মি, ডিজিএফআই, এনএসআই ও বিজিবি যৌথভাবে তাঁর সন্ধানে অভিযান চালাচ্ছে।

সীমান্ত, এয়ারপোর্ট, সমুদ্রবন্দর ও ইমিগ্রেশন পয়েন্টে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে যাতে তিনি দেশত্যাগ করতে না পারেন।

সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা গুজব ঘুরছে—কেউ বলছে তিনি “দিল্লি-পালানো বিমানে হাসিনার সঙ্গে ছিলেন”, আবার কেউ দাবি করছে তিনি “তামাবিল সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে গেছেন।” তবে এসব তথ্য যাচাই করা যায়নি।

সেনাবাহিনী জানিয়েছে, “তিনি অভিযুক্ত, তাই তাঁর নিরাপত্তা ও বিচার উভয়ই আমাদের দায়িত্ব। আমরা কোনোভাবেই তাঁকে পালাতে দেব না।”

আর্মির অবস্থান: আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারে আপসহীন

আর্মির অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল মেজর জেনারেল মোহাম্মদ হাকিমুজ্জামান ১১ অক্টোবর সাংবাদিক-এর সঙ্গে এক যৌথ বিবৃতিতে জানান—“বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সংবিধানসম্মত আইন মেনে চলে। ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে কোনো কম্প্রোমাইজ হবে না। ১৫ জন কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে, কারও প্রতি পক্ষপাত বা প্রতিশোধ নয়।”

তিনি আরও বলেন—“যে সময়গুলোর অভিযোগ এসেছে (২০০৭, ২০০৯, ২০১৪–১৫), সেসব বিষয়ে যথাযথ তদন্ত চলবে এবং আদালত যা নির্দেশ দেবে, সেনাবাহিনী তা মেনে চলবে।”

রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া

এই ঘটনাকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।

বিএনপি এক বিবৃতিতে বলেছে—“এটি প্রতিষ্ঠান নয়, ব্যক্তির অপরাধের বিচার—গণতন্ত্রের জন্য ইতিবাচক সিগন্যাল।”

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের অবশিষ্ট নেতারা দাবি করেছেন, এটি “আর্মির একতরফা অবস্থান” যা “অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক লক্ষ্য” পূরণের অংশ হতে পারে।

সোশ্যাল মিডিয়ায় এক্স (পূর্বে টুইটার)-এ প্রশংসা ও সন্দেহের মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে—কেউ লিখেছেন, “বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অবশেষে ন্যায়বিচারের পথে হাঁটছে।”

অন্যরা বলেছেন, “মেজর কবিরকে টিপ-অফ দিয়ে পালাতে সাহায্য করেছে আর্মিরই কেউ।”

জেন-জেড অ্যাকটিভিস্টরা পোস্ট করেছেন, “ওয়াকার বাঁচাতে নাটক শুরু—সজাগ থাকো।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও পর্যবেক্ষণ

জাতিসংঘ (UN) এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে, তবে বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।

এএফপি (AFP) রিপোর্টে বলা হয়েছে, সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে এই ঘটনায় মানসিক চাপ ও মনোবল পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

অন্যদিকে, ভারতের গণমাধ্যমে মেজর কবিরের সঙ্গে শেখ হাসিনার সম্ভাব্য যোগাযোগ নিয়ে জোরালো আলোচনা চলছে।

পরিবর্তনের প্রতিচ্ছবি

অগাস্ট ২০২৪ পরবর্তী রাজনৈতিক রূপান্তরের পর বাংলাদেশে গুম, দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচার প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে। সেনাবাহিনীর সাম্প্রতিক পদক্ষেপকে অনেক বিশ্লেষক “অতীতের অন্ধকার অধ্যায়ের জবাব” হিসেবে দেখছেন।

তবে মেজর জেনারেল কবির আহমেদের নিখোঁজ হওয়া এই প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে।
আগামী ২২ অক্টোবর অভিযুক্তদের আদালতে হাজিরার দিন দেশ-বিদেশের নজর থাকবে ঢাকায় আইসিটি-১-এর দিকে।