বাংলাদেশ-তুরস্ক প্রতিরক্ষা চুক্তি: হিসার-ও সিস্টেম ক্রয়ে আলোচনা

বাংলাদেশ-তুরস্ক প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় নতুন অধ্যায়: হিসার-ও এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনার উন্নত পর্যায়ে আলোচনা চলছে।

বিশেষ প্রতিবেদন: বাংলাদেশ ও তুরস্কের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান-এর সাম্প্রতিক তুরস্ক সফরের পর দুই দেশের প্রতিরক্ষা কূটনীতি অভূতপূর্ব গতিতে অগ্রসর হচ্ছে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ এখন হিসার-ও (HİSAR-O) মাঝারি পাল্লার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ক্রয়ের জন্য তুরস্কের সঙ্গে উন্নত পর্যায়ের আলোচনায় রয়েছে, যা দেশের আকাশ প্রতিরক্ষায় এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হতে যাচ্ছে।

আধুনিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিকে বাংলাদেশ

হিসার-ও সিস্টেমটি ২৫ থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এবং এটি ন্যাটো-সামঞ্জস্যপূর্ণ। সিস্টেমটিতে রয়েছে উন্নত রাডার ট্র্যাকিং, স্বয়ংক্রিয় লঞ্চার, কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল ইউনিট এবং বহুমুখী মিসাইল ইন্টারসেপ্টর।

তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিষ্ঠান আসেলসান (ASELSAN) এবং রকেটসান (ROKETSAN) যৌথভাবে এই সিস্টেম তৈরি করেছে, যা বর্তমানে তুরস্কের সামরিক বাহিনীতে সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সূত্র বলছে, বাংলাদেশ এই সিস্টেম ক্রয় করলে দক্ষিণ এশিয়ায় এটি হবে প্রথম ন্যাটো-গ্রেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, যা দেশীয় আকাশ প্রতিরক্ষায় এক বড় অগ্রগতি নির্দেশ করবে।

তুরস্ক সফর: উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক ও প্রযুক্তি আলোচনা

এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান ১–৫ অক্টোবর তুরস্ক সফরকালে তুর্কি বিমানবাহিনীর সদর দফতরসহ আসেলসান, রকেটসান ও তুর্কিশ এয়ারস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ (TAI) পরিদর্শন করেন।

এই বৈঠকগুলোতে রাডার প্রযুক্তি, ড্রোন, আকাশ প্রতিরক্ষা, এবং যৌথ উৎপাদন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়।

আসেলসানের মহাব্যবস্থাপক আহমেত আকিওল বলেন,“বন্ধুত্বপূর্ণ ও অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করা আমাদের অঙ্গীকার। বাংলাদেশ একটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু।”

হিসার-ও ছাড়াও আলোচনায় সিপার (SİPER)

তুরস্কের দীর্ঘ-পাল্লার সিপার (SİPER) সিস্টেম নিয়েও বাংলাদেশের আগ্রহ রয়েছে। এই সিস্টেমটি ১৮০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ব্যালিস্টিক ও হাইপারসনিক প্রতিরক্ষা সক্ষমতা অর্জন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো জানিয়েছে, তুরস্ক বাংলাদেশকে ৬০০ মিলিয়ন ডলারের একটি প্রতিরক্ষা প্যাকেজ প্রস্তাব করেছে, যাতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—

এফ-৭ যুদ্ধবিমানের আপগ্রেড

প্রিসিশন-গাইডেড মিউনিশন

মুরাদ এএসএ (ASELSAN AESA) রাডার

এবং প্রশিক্ষণ সহ প্রযুক্তি স্থানান্তর চুক্তি

অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক মাত্রা

২০২৪ সালে বাংলাদেশ তুরস্ক থেকে ২২.৫ মিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমদানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যৌথ উৎপাদন এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর শুরু হলে এই পরিমাণ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে “শতকরা মিলিয়ন ডলার” পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।

একই বছর দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে, যার একটি বড় অংশই প্রতিরক্ষা খাতনির্ভর।

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও কৌশলগত গুরুত্ব

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার এই ধারা দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে নতুন ভারসাম্য সৃষ্টি করছে।

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাইফুল ইসলাম বলেন, “তুরস্কের যুদ্ধ-পরীক্ষিত এবং তুলনামূলকভাবে সাশ্রয়ী প্রযুক্তি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা স্বনির্ভরতা অর্জনের ক্ষেত্রে একটি কার্যকর ও টেকসই সমাধান।”

তবে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষর না হওয়া পর্যন্ত এই সহযোগিতা এখনো “উন্নত আলোচনার পর্যায়ে” রয়েছে।

সরকারি অবস্থান ও পরবর্তী পদক্ষেপ

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, আলোচনাটি বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা স্থাপনা ও আকাশ প্রতিরক্ষা জোরদার করার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। তবে এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি প্রকাশ করা হয়নি।

বিমানবাহিনী বলেছে, আলোচনার সব দিক পর্যালোচনার পরই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে।