পাকিস্তানে ওরাকজাই অভিযানে ১১ সৈনিক শহীদ, ১৯ সন্ত্রাসী নিহত

ওরাকজাইতে সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সংঘর্ষে ১১ পাকিস্তানি সেনা শহীদ।

বিশ্ব ডেস্ক: পাকিস্তানের সামরিক গণমাধ্যম শাখা ইন্টার-সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস (আইএসপিআর) জানিয়েছে, খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের ওরাকজাই জেলায় ভারত-সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ‘ফিতনা আল খারিজ’-এর বিরুদ্ধে একটি গোয়েন্দা-ভিত্তিক অভিযানে ১১ জন সেনা সদস্য শহীদ হয়েছেন।

এই অভিযানটি ৭ থেকে ৮ অক্টোবর রাতভর চলে। তীব্র গুলিবিনিময়ের পর ১৯ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।

ওরাকজাই জেলা আফগানিস্তান সীমান্ত সংলগ্ন একটি দুর্গম এলাকা, যা দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। সেনাবাহিনী জানায়, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে অভিযানটি পরিচালিত হয়েছিল। অভিযানের লক্ষ্য ছিল ‘ফিতনা আল খারিজ’ নামের একটি গোষ্ঠী, যা নিষিদ্ধ তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান (টিটিপি)-এর ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। ২০২৫ সালের প্রথম নয় মাসে খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসী হামলার সংখ্যা ২০২৪ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

আইএসপিআর জানিয়েছে, শহীদ ১১ জনের মধ্যে দুইজন অফিসার—লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুনায়েদ তারিক (৩৯) এবং মেজর তাইয়্যাব রাহাত (৩৩)—অভিযানে নেতৃত্ব দেন। শহীদদের মধ্যে আরও ছিলেন নাইব সুবেদার আজম গুল (৩৮), নাইক আদিল হুসেন (৩৫), নাইক গুল আমির (৩৪), ল্যান্স নাইক শের খান (৩১), ল্যান্স নাইক তালিশ ফারাজ (৩২), ল্যান্স নাইক ইরশাদ হুসেন (৩২), সিপাহী তুফায়েল খান (২৮), সিপাহী আকিব আলী (২৩) এবং সিপাহী মুহাম্মদ জাহিদ (২৪)।

এই অভিযানে শহীদদের দেহ রাওয়ালপিন্ডির চকলালা গ্যারিসনে আনা হয় এবং পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ শেহবাজ শরীফ, রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারি, সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল সৈয়দ আসিম মুনির, ফেডারেল মন্ত্রীবৃন্দ ও বেসামরিক কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। পরবর্তীতে শহীদদের নিজ নিজ জন্মভূমিতে দাফন করা হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরীফ শহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, “এই বীর সেনাদের ত্যাগ পাকিস্তানের অবিচল জাতীয় সংকল্পের প্রতীক। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তাদের রক্ত বৃথা যাবে না।” তিনি আরও বলেন, “ভারত-সমর্থিত সন্ত্রাসীদের এই ষড়যন্ত্র সফল হবে না; পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় জাতি ঐক্যবদ্ধ।”

রাষ্ট্রপতি আসিফ আলী জারদারি এক বিবৃতিতে বলেন, “ওরাকজাইয়ে ১৯ জন ভারত-পৃষ্ঠপোষক খারিজ সন্ত্রাসীকে নির্মূল করা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অসাধারণ সাফল্য। লেফটেন্যান্ট কর্নেল জুনায়েদ তারিক ও মেজর তাইয়্যাব রাহাতসহ সব শহীদ জাতির প্রকৃত নায়ক।” তিনি শহীদ পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে যোগ করেন, “এই শহীদরা ত্যাগের এক চিরন্তন উদাহরণ স্থাপন করেছেন।”

পিপিপি চেয়ারপারসন বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি এক শোকবার্তায় বলেন, “১১ জন কর্মকর্তার শাহাদাতে গোটা জাতি শোকাহত। আমরা সুরক্ষাবাহিনীর সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে সর্বাত্মক সমর্থন জানাচ্ছি।”
এছাড়াও জাতীয় সংসদের স্পিকার সর্দার আয়াজ সাদিক বলেন, “সশস্ত্র বাহিনীর আত্মত্যাগ কখনো বৃথা যাবে না। পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে অবিচল।”

আইএসপিআর জানায়, ওরাকজাই এলাকায় এখনো “স্যানিটাইজেশন অপারেশন” চলছে, যাতে বাকি সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করে এলাকাটি সম্পূর্ণ নিরাপদ করা যায়। সামরিক কর্মকর্তারা জানান, এই অভিযানের লক্ষ্য ছিল সীমান্তবর্তী অঞ্চলে সক্রিয় ভারত-সমর্থিত সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কগুলো ধ্বংস করা।

বিশ্লেষকদের মতে, এই ঘটনা পাকিস্তানে ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী হামলার একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। টিটিপি ও সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলো আফগান সীমান্তের আশপাশের এলাকায় ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করছে। সেনাবাহিনীর নতুন অভিযানগুলো সেই হুমকি মোকাবিলার প্রচেষ্টার অংশ।

সাম্প্রতিক মাসগুলোতে খাইবার পাখতুনখোয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর একাধিক হামলার পর এই অভিযানটি আসে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, পাকিস্তানকে এখন শুধু প্রতিক্রিয়ামূলক নয়, বরং প্রতিরোধমূলক কৌশল গ্রহণ করতে হবে যাতে সীমান্তবর্তী এলাকায় সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠতে না পারে।

এই ঘটনার মাধ্যমে আবারও স্পষ্ট হয়েছে যে, পাকিস্তানের সুরক্ষাবাহিনী দেশব্যাপী সন্ত্রাসবাদ দমনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। শহীদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই নিরাপত্তার লড়াই এখন জাতীয় ঐক্যের পরীক্ষার মুখে।