দুটি ক্রুজ মিসাইল ধ্বংস, IBCS সিস্টেমের পূর্ণ সক্ষমতা প্রদর্শন

মার্কিন সেনাবাহিনীর মিসাইল প্রতিরক্ষায় যুগান্তকারী সফলতা।হোয়াইট স্যান্ডসে দুটি ক্রুজ মিসাইল ধ্বংস: আধুনিক যুদ্ধের নতুন দিগন্ত।
বিশ্ব ডেস্ক: মার্কিন সেনাবাহিনী বিমান ও মিসাইল প্রতিরক্ষা প্রযুক্তিতে এক যুগান্তকারী সাফল্য অর্জন করেছে। বৃহঃবার (২ অক্টোবর) নিউ মেক্সিকোর হোয়াইট স্যান্ডস মিসাইল রেঞ্জে (White Sands Missile Range) সেনাবাহিনীর ৪৩তম এয়ার ডিফেন্স আর্টিলারি রেজিমেন্টের ৩য় ব্যাটালিয়ন একটি অটোমেটেড কমান্ড সিস্টেম ব্যবহার করে দুটি ম্যানুভারিং ক্রুজ মিসাইলের সারোগেট টার্গেট সফলভাবে ধ্বংস করেছে।
এটি মার্কিন সেনাবাহিনীর ইন্টিগ্রেটেড ব্যাটেল কমান্ড সিস্টেম (Integrated Battle Command System বা IBCS)-এর পূর্ণ সক্ষমতা প্রদর্শন করেছে, যা ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করবে।
এই পরীক্ষাটি পরিচালনা করেছে প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ অফিস মিসাইলস অ্যান্ড স্পেস (Program Executive Office Missiles and Space)। পরীক্ষায় সেনাবাহিনীর সৈন্যরা উন্নত সেন্সর নেটওয়ার্কের মাধ্যমে রিয়েল-টাইম ডেটা সংগ্রহ করে লক্ষ্য নির্ধারণ করে এবং প্রতিরক্ষা অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে দুটি ক্রুজ মিসাইল ধ্বংস করতে সক্ষম হয়।
পরীক্ষার সময় ক্রুজ মিসাইলগুলো নিম্ন উচ্চতায় এবং জটিল গতিপথে ম্যানুভার করছিল, যা বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রের মতো চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। তবুও মার্কিন সৈন্যরা প্রথম প্রচেষ্টাতেই ‘ডুয়াল মিসাইল কিল’ অর্জন করে। অর্থাৎ, তারা একই সঙ্গে দুটি লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে।
সেনাবাহিনী জানিয়েছে, এই পরীক্ষা কোনো বাস্তব হুমকির প্রতিক্রিয়া নয়, বরং এটি ছিল একটি নিয়ন্ত্রিত অপারেশনাল টেস্ট, যার লক্ষ্য ছিল IBCS-এর যুদ্ধক্ষেত্র প্রস্তুতি যাচাই করা। এই সফলতায় IBCS-এর Follow-On Operational Test and Evaluation (FOT&E) ধাপ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, যা পূর্ণ মোতায়েনের পথে একটি বড় অগ্রগতি।
IBCS সিস্টেমের বৈশিষ্ট্য
নর্থ্রপ গ্রুম্যান (Northrop Grumman) কর্তৃক তৈরি IBCS সিস্টেমটি একটি উন্নত কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল নেটওয়ার্ক, যা বিভিন্ন সেন্সর, রাডার এবং অস্ত্র সিস্টেমকে একত্রে সংযুক্ত করে একটি সমন্বিত প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক গঠন করে।
এর মূল দর্শন হলো “Any Sensor, Best Weapon”, অর্থাৎ যেকোনো সেন্সর থেকে প্রাপ্ত তথ্য ব্যবহার করে সবচেয়ে উপযুক্ত অস্ত্রের মাধ্যমে হুমকি মোকাবিলা করা।
এই প্রযুক্তি সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যগত বিচ্ছিন্ন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে সরে এসে নেটওয়ার্ক-সেন্ট্রিক ওয়ারফেয়ার ধারণার বাস্তবায়ন ঘটায়।
IBCS সিস্টেমের মাধ্যমে—সেন্সর ও অস্ত্রের মধ্যে তাৎক্ষণিক তথ্য বিনিময় সম্ভব।
একাধিক লক্ষ্যবস্তু একই সঙ্গে ট্র্যাক ও ধ্বংস করা যায়।
আকাশ, স্থল ও সমুদ্রের হুমকির বিরুদ্ধে সমন্বিত প্রতিরক্ষা গঠন করা যায়।
পূর্ববর্তী বছরগুলোতে এই সিস্টেমের বিভিন্ন পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২০২০ সালে এটি নিম্ন উচ্চতায় উড়ে যাওয়া ক্রুজ মিসাইল সারোগেট ধ্বংস করে এবং ২০২২ সালে ব্যালিস্টিক হুমকির বিরুদ্ধে সফলতা দেখিয়েছিল। এবারের পরীক্ষায় দ্রুতগামী ম্যানুভারিং মিসাইলের বিরুদ্ধেও কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে, যা আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে এর প্রয়োগযোগ্যতা আরও শক্তিশালী করে।
আন্তর্জাতিক প্রভাব ও কৌশলগত গুরুত্ব
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সাফল্য মার্কিন সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা আধুনিকীকরণের একটি বড় পদক্ষেপ।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত এবং ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মিসাইল কার্যক্রমের প্রেক্ষাপটে ক্রুজ মিসাইল ও ড্রোনের হুমকি এখন বৈশ্বিক নিরাপত্তার অন্যতম বড় উদ্বেগ।
IBCS প্রযুক্তি এসব হুমকি মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রকে আরও নির্ভরযোগ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।
এছাড়া, মিত্রদেশগুলোও এই প্রযুক্তিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। পোল্যান্ড ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ২.৫ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তির মাধ্যমে এই সিস্টেমের প্রথম আন্তর্জাতিক ব্যবহারকারী হতে যাচ্ছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা দপ্তর জানিয়েছে, “এই সাফল্য আমাদের বিমান ও মিসাইল প্রতিরক্ষা সক্ষমতা উন্নয়নে প্রতিশ্রুতির একটি বাস্তব প্রতিফলন।” ভবিষ্যতে IBCS সিস্টেমকে আর্মির একাধিক ইউনিটে পূর্ণরূপে মোতায়েন করা হবে, যা বহুমাত্রিক যুদ্ধক্ষেত্রে (multi-domain operations) কার্যকর প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
মার্কিন সেনাবাহিনী বর্তমানে IBCS সিস্টেমকে প্যাট্রিয়ট (Patriot), THAAD, ও F-35 সেন্সর নেটওয়ার্ক-এর সঙ্গে সমন্বিত করার কাজ করছে। এর ফলে শত্রুপক্ষের ড্রোন, ব্যালিস্টিক মিসাইল বা ক্রুজ মিসাইলের বিরুদ্ধে রিয়েল-টাইম প্রতিক্রিয়া দেওয়া আরও সহজ হবে।
সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেন, “IBCS শুধু একটি সিস্টেম নয়, এটি ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্রের ‘ডিজিটাল ব্রেন’—যা সেন্সর ও অস্ত্রের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে যুদ্ধের গতি ও নির্ভুলতা বাড়াবে।”
হোয়াইট স্যান্ডসের এই পরীক্ষা যুক্তরাষ্ট্রের মিসাইল প্রতিরক্ষা সক্ষমতার এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
দুটি ক্রুজ মিসাইল একযোগে ধ্বংসের মাধ্যমে IBCS প্রমাণ করেছে যে আধুনিক প্রযুক্তি, নেটওয়ার্ক সংযোগ এবং দ্রুত প্রতিক্রিয়া মিলিয়ে ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্র হবে প্রযুক্তিনির্ভর ও নির্ভুলতার প্রতিযোগিতা।
এটি শুধু মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য নয়, বৈশ্বিক প্রতিরক্ষা ইতিহাসেও এক নতুন দৃষ্টান্ত।






