বাংলাদেশের সামরিক শক্তি: বিশ্ব গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ

  • সাম্প্রতিক প্রতিরক্ষা উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা
  • চীন থেকে যুদ্ধবিমান ক্রয়
  • যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি
  • রাশিয়া ও তুরস্কের সঙ্গে যৌথ অভ্যাস এবং প্রস্তাব

টুইট প্রতি‌বেদক: বাংলাদেশের সামরিক শক্তি দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় এবং বিশ্বে ৩৫তম শক্তিশালী সেনাবাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

২০২৫ সালের গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার (GFP) ইনডেক্স অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১৪৫টি দেশের মধ্যে ৩৫তম স্থানে রয়েছে — গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ উন্নতি।

দেশের ক্রমবর্ধমান মানবসম্পদ, প্রতিরক্ষা বাজেট বৃদ্ধি, এবং আধুনিকীকরণ প্রকল্পের কারণে এ উন্নতি সম্ভব হয়েছে। বিশ্ব গণমাধ্যম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে “উদীয়মান শক্তি” হিসেবে অভিহিত করছে, বিশেষ করে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বৃদ্ধির কারণে।

গ্লোবাল র‍্যাঙ্কিং ও সামরিক ক্ষমতা বিশ্লেষণ

গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স ২০২৫: বাংলাদেশ ৩৫তম (Power Index: 0.6062)। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত (৪র্থ) ও পাকিস্তানের পর তৃতীয়।

সেনাসংখ্যা: মোট ৩৩ লাখ (অ্যাকটিভ, রিজার্ভ ও প্যারামিলিটারি মিলিয়ে)।

বিমানবাহিনী: ১৪৭টি যুদ্ধবিমান (এর মধ্যে F-7, Yak-130, MiG-29 এবং আসন্ন J-10CE অন্তর্ভুক্ত)।

নৌবাহিনী: সাবমেরিন ২টি, ফ্রিগেট ৬টি, করভেট ৪টি এবং কোস্টগার্ড জাহাজসহ ক্রমবর্ধমান নৌবহর।

স্থলসেনা: ৬০০-এরও বেশি ট্যাঙ্ক, ৯০০টি সাঁজোয়া যান, আধুনিক আর্টিলারি সিস্টেম ও স্বয়ংক্রিয় রাডার ইউনিট।

অন্যদিকে মিলিটারি পাওয়ার র‍্যাঙ্কিংস (MPR) বাংলাদেশকে ৪৯তম স্থানে রেখেছে, যেখানে মানবসম্পদের দক্ষতা ও যুদ্ধ-প্রস্তুতি গুরুত্ব পেয়েছে।

সাম্প্রতিক প্রতিরক্ষা উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা

চীন থেকে যুদ্ধবিমান ক্রয়

বাংলাদেশ ২০টি চীনা J-10CE মাল্টিরোল ফাইটার জেট কেনার চুক্তি করেছে (মূল্য: ২.২ বিলিয়ন ডলার)। এগুলো ২০২৭ সালের মধ্যে সরবরাহ সম্পন্ন হবে। ভারত এটিকে “প্রতিরক্ষা ভারসাম্য পরিবর্তনের” ইঙ্গিত হিসেবে দেখছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি

২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য আদানপ্রদান ও উন্নত সরঞ্জাম সরবরাহ করবে।

আন্তর্জাতিক মহড়া ও সহযোগিতা

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত ‘WEST-2025’ মহড়ায় (১–১৭ সেপ্টেম্বর) অংশগ্রহণ করেছে। এটি বাংলাদেশি বাহিনীর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সমন্বয়ের প্রমাণ।

তুরস্কের প্রস্তাব

তুরস্ক বাংলাদেশকে উন্নত অস্ত্র, সাঁজোয়া যান এবং ড্রোন প্রযুক্তি সরবরাহের আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এতে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিরক্ষা ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।

দুর্ঘটনা ও দুর্বলতা

২০২৫ সালের জুনে চীনা তৈরি F-7BGI যুদ্ধবিমান ক্র্যাশে ২০ জন নিহত হন, যা বিমানবাহিনীর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকাশ করেছে।

বিশ্ব গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ

ইতিবাচক দিক

প্রথম আলো, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ও ওয়ারপাওয়ার জানিয়েছে—বাংলাদেশের সেনাবাহিনী দক্ষিণ এশিয়ার “উদীয়মান শক্তি”। বিশেষত, মানবসম্পদ, প্রযুক্তি গ্রহণ এবং প্রশিক্ষণের মান বৃদ্ধি দেশের প্রতিরক্ষা কাঠামোকে নতুন উচ্চতায় তুলেছে।

উদ্বেগের দিক

ইকোনমিক টাইমস ও শিলং টাইমস চীন-পাকিস্তান ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার উদ্বেগের কথা বলেছে। অ্যালজাজিরা ও এএফপি বাংলাদেশে সেনা ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সম্পর্ক নিয়ে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করেছে।

দ্য ফেডারেল অভিযোগ করেছে যে পার্বত্য চট্টগ্রামে “উস্কানিমূলক সামরিক উপস্থিতি” বাড়ছে, যা আঞ্চলিক সংবেদনশীলতা বাড়াতে পারে।

অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষণ

ওবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশন (ORF) উল্লেখ করেছে—বাংলাদেশের সামরিক উন্নয়ন “প্রশংসনীয়”, তবে টেকসই গণতন্ত্রের জন্য বেসামরিক-সামরিক সম্পর্কের ভারসাম্য প্রয়োজন।

কৌশলগত মূল্যায়ন

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বর্তমানে “Three-Dimensional Defence Force” ধারণার অধীনে কাজ করছে—স্থল, নৌ ও আকাশ প্রতিরক্ষা একত্রিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত বাহিনী গঠন করছে।

২০২৫-৩০ সালের “Forces Goal Update Plan” অনুযায়ী, প্রতিটি ডিভিশনে আধুনিক আর্টিলারি ও ড্রোন ইউনিট সংযোজন, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে নৌ-ঘাঁটি সম্প্রসারণ, রাডার ও সাইবার প্রতিরক্ষা উন্নয়ন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অভিযানে আরও সক্রিয় ভূমিকা—এসবই অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশের সামরিক শক্তি দক্ষিণ এশিয়ার নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে উঠছে। বিশ্ব মিডিয়ার বিশ্লেষণে দেখা যায়—দেশটি এখন আর কেবল “নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক” নয়, বরং “কৌশলগত খেলোয়াড়” হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে।

তবে, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, সীমান্ত উত্তেজনা ও মানবাধিকার ইস্যু সামরিক উন্নয়নের গতিকে প্রভাবিত করতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন।

সূত্র: Global Firepower Index 2025, Reuters, Al Jazeera, ORF, WarPower Bangladesh, Economic Times, AFP