শেখ হাসিনা-পরিবারের ফ্রোজেন সম্পদ উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ
পাচার অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ: ১২ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি সই করতে ব্যাংকগুলোকে আহ্বান, শেখ হাসিনা-পরিবার ও ১০ ব্যবসায়ী গ্রুপের সম্পদ লক্ষ্য।
টুইট ডেস্ক: সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবারের সদস্য এবং ১০টি বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নামে বিদেশে পাচার হওয়া কোটি কোটি টাকার অর্থ ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক ১২টি আন্তর্জাতিক সম্পদ পুনরুদ্ধার ও আইনজীবী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি সই করতে ৩২টি বাণিজ্যিক ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ উদ্ধারের প্রক্রিয়ায় প্রশাসনিক, আইনি এবং তদন্তমূলক সহায়তা প্রদান করবে।
সোমবার (৬ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যাতে ব্যাংকগুলো কনসোর্টিয়াম গঠন করে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ) সই করবে। অভিযোগ অনুসারে, এই পাচারের মাধ্যমে ২০০৯-২০২৩ সালের মধ্যে ব্যাঙ্কিং খাতের মাধ্যমে ১৭-১৮ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২.২ লক্ষ কোটি টাকা) সাইফন করা হয়েছে, যার একটি অংশ শেখ হাসিনা ও পরিবারের উপকারে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এই উদ্যোগটি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের অংশ, যা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অগ্রাধিকার। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দেবে। সভায় ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ওমর ফারুক খান বলেন, “নেতৃত্বদানকারী হিসেবে কিছু ব্যাংক অন্যদের সাথে কনসোর্টিয়াম গঠন করে এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করবে। চুক্তি সম্পন্ন হলে পুনরুদ্ধারকৃত অর্থ কীভাবে জমা দেওয়া হবে, তা নির্ধারণ করা হবে।” তিনি আরও জানান, বিশেষ সিআইডি প্রাথমিকভাবে ১১টি দেশীয় শিল্পগোষ্ঠীকে শনাক্ত করেছে, যার মধ্যে বসুন্ধরা, নাসা ও এস আলম গ্রুপ অন্তর্ভুক্ত।
চুক্তির প্রক্রিয়া এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশ অনুসারে, ব্যাংকগুলো এই ১২টি প্রতিষ্ঠানের সাথে এনডিএ সই করে কাজ শুরু করবে। চুক্তির পর প্রতিষ্ঠানগুলো পাচারকৃত অর্থের খোঁজ, আইনি লড়াই এবং উদ্ধার নিশ্চিত করবে, এবং পারিশ্রমিক হিসেবে উদ্ধার অর্থের একটি শতাংশ পাবে। ব্যাংকগুলোকে টিকা ২০০ কোটি বা তার বেশি মূল্যের সন্দেহজনক লোনের তালিকা জমা দিতে হবে, যা বিএফআইইউ যাচাই করবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম এখনও প্রকাশিত হয়নি, তবে এগুলো সম্পদ পুনরুদ্ধারে বিশেষজ্ঞ আইনি ফার্ম।
এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, “এই উদ্যোগটি কোনো একটি ব্যাংকের নয়, বরং একাধিক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত একটি বৃহত্তম ব্যাঙ্কিং উদ্যোগ।” পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী যোগ করেন, “কেন্দ্রীয় ব্যাংক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ১২টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের নাম দিয়েছে এবং ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে এসব প্রতিষ্ঠানের সাথে এনডিএ সই করে কাজ করতে।”
শেখ হাসিনা-পরিবার ও ১০ ব্যবসায়ী গ্রুপ
এই উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য ১১টি প্রায়োরিটি কেস, যার মধ্যে শেখ হাসিনা, তার ছেলে সাজীব ওয়াজেদ জয়, কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা এবং রেহানার ছেলে রাধওয়ান মুজিব সিদ্দিকের সম্পদ। অন্যান্য ১০টি গ্রুপ: এস আলম, বেক্সিমকো, সামিট, বসুন্ধরা, জেমকন, ওরিয়ন, নাবিল, নাসা, সিকদার এবং আরামিট। অভিযোগ: এই গ্রুপগুলোর মাধ্যমে পাচার অর্থ শেখ হাসিনা-পরিবারের উপকারে গেছে।
ফ্রোজেন সম্পদের সাম্প্রতিক চিত্র (২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত)
বাংলাদেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী ও প্রভাবশালী পরিবারগুলোর বিপুল পরিমাণ সম্পদ বিদেশে ফ্রিজ করা হয়েছে বলে সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। এতে দেখা যায়, শেখ হাসিনা পরিবার–এর নামে স্থানীয় ও বিদেশী মিলে মোট ৫৭২৫.৭ কোটি টাকা ফ্রোজেন রয়েছে, যার বেশিরভাগই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডায়।
এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের প্রায় ১২০০ কোটি টাকারও বেশি সম্পদ ফ্রিজ করা হয়েছে, যার মধ্যে শুধু যুক্তরাজ্যেই ২৬০ মিলিয়ন পাউন্ড আটকে আছে। বেক্সিমকো গ্রুপের প্রায় ৮০০ কোটি টাকার সম্পদ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায়, এবং বসুন্ধরা গ্রুপের ৭০০ কোটিরও বেশি সম্পদ হংকং ও থাইল্যান্ডে জব্দ করা হয়েছে।
এছাড়া সামিট, নাসা, সিকদারসহ অন্যান্য গ্রুপের সম্মিলিতভাবে ৩৫০০ কোটিরও বেশি টাকার সম্পদ যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও বিভিন্ন অফশোর অ্যাকাউন্টে ফ্রিজ করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে বিদেশে ফ্রোজেন থাকা এই সম্পদের পরিমাণ দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং (পাচার অর্থ) এবং দুর্নীতির মাধ্যমে বিদেশে সাইফন করা সম্পদ উদ্ধারের প্রক্রিয়া একটি জটিল, বহু-স্তরীয় আইনি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা-ভিত্তিক। এটি প্রধানত মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ (পরিবর্তিত ২০১৫ ও ২০২৩), দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪, অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্ট আইন, ২০১২ এবং সম্পদ ট্রেসিং ও ফরফিটিং আইন, ২০১৯ এর অধীনে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এই প্রক্রিয়ার কেন্দ্রবিন্দু, যা সাসপিশাস ট্রানজ্যাকশন রিপোর্ট (এসটিআর) বিশ্লেষণ করে তদন্ত শুরু করে।
২০২৫ সালে এই প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়েছে, বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পরিবারের সাথে যুক্ত পাচার কেসে, যেখানে বাংলাদেশ ব্যাংক ১২টি আন্তর্জাতিক ফার্মের সাথে চুক্তির নির্দেশ দিয়েছে। মোট পাচার অর্থ ১৭-১৮ বিলিয়ন ডলার (প্রায় ২.২ লক্ষ কোটি টাকা) ধরা হয়েছে, যার উদ্ধারে ৩-৪ বছর লাগতে পারে।