বান্দরবানে শিশু অধিকার সপ্তাহ উদযাপন

বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ-২০২৫: বান্দরবানে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শিশু অধিকারের প্রতি সচেতনতা

বান্দরবান থেকে অসীম রায়/অশ্বিনী: প্রতি বছরের মতো এবছরও অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার বিশ্ব শিশু দিবস ও শিশু অধিকার সপ্তাহ উদযাপিত হয়েছে। এই দিবসটির সূচনা হয়েছিল ১৯৫৪ সালে জাতিসঙ্ঘের উদ্যোগে, যার উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমির উদ্যোগে দেশব্যাপী এই দিবস পালিত হয়, যা ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ৫ অক্টোবর পর্যন্ত চলে। এবছরের থিম ‘শিশুর জন্য বিনিয়োগ করি, ভবিষ্যতের বিশ্ব গড়ি’ নিয়ে সারা দেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস শিশুদের অধিকার রক্ষায় সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টার আহ্বান জানিয়েছেন।

বান্দরবান পার্বত্য জেলায়ও এই উদ্যোগে স্থানীয় প্রশাসন এবং শিশু একাডেমি যৌথভাবে একটি আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে, যা শিশু অধিকারের প্রতি স্থানীয় সমাজকে সচেতন করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

আজ সোমবার (৬ অক্টোবর) সকালে বান্দরবান জেলা শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণে এই অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়। বান্দরবান পার্বত্য জেলা প্রশাসন এবং বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বান্দরবান জেলার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই কর্মসূচিতে প্রায় ১০০ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল শিশুদের মৌলিক অধিকার যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা এবং সমান অবসর নিশ্চিত করার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

জেলা শিশু একাডেমির বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা এই সুযোগে তাদের অভিজ্ঞতা ও প্রত্যাশা শেয়ার করেন, যা অনুষ্ঠানকে আরও জীবন্ত করে তোলে।

প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বান্দরবান পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি। তিনি সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, “শিশুরা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের অধিকার রক্ষা ছাড়া কোনো উন্নয়ন সম্ভব নয়। পার্বত্য অঞ্চলে শিশুদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় সরকারের বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, এবং এই ধরনের অনুষ্ঠান সেই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করবে।” তাঁর বক্তব্যে শিশুদের প্রতি সমাজের দায়িত্বশীলতা এবং পার্বত্য জেলার স্থানীয় চ্যালেঞ্জ যেমন দুর্গমতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের মধ্যে অধিকার সুরক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন শাহাদাত হোসেন, শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা, শিশু একাডেমি, বান্দরবান; সুপন চাকমা, উপপরিচালক, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, বান্দরবান; মিল্টন মহূরী, উপপরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তর, বান্দরবান; এবং মনজুর আহমেদ, সহকারী পরিচালক, জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো, বান্দরবান। এই অতিথিদের উপস্থিতি অনুষ্ঠানকে আরও গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

আলোচনা সভায় বক্তারা শিশুদের অধিকার রক্ষা, শিক্ষার মানোন্নয়ন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের দৃঢ়তা এবং মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে অভিভাবক ও সমাজের সম্মিলিত ভূমিকার উপর গুরুত্বারোপ করেন। শাহাদাত হোসেন বলেন, “শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী প্রত্যেক শিশুর শিক্ষা ও সুরক্ষার অধিকার রয়েছে। বান্দরবানের মতো পার্বত্য এলাকায় এই অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসন এবং এনজিওগুলোর সহযোগিতা অপরিহার্য।”

অন্যদিকে, সুপন চাকমা মহিলা ও শিশু সুরক্ষায় সরকারি উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন এবং কন্যাশিশু অধিকারের উপর বিশেষ জোর দেন। মিল্টন মহূরী সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রোগ্রামগুলোর মাধ্যমে শিশু কল্যাণে কীভাবে কাজ হচ্ছে তা বর্ণনা করেন, যেমন পুষ্টি কর্মসূচি এবং স্কলারশিপ। মনজুর আহমেদ উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, “পার্বত্য জেলায় ড্রপআউট রেট কমাতে অভিভাবকদের অংশগ্রহণ বাড়ানো দরকার।” সভায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীরা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন, যেমন স্কুলে নিরাপত্তা এবং খেলাধুলার অভাব নিয়ে কথা বলেন, যা বক্তাদের দ্বারা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।

অনুষ্ঠানের শেষভাগে শিশুদের অংশগ্রহণে একটি মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা অনুষ্ঠিত হয়। এতে পার্বত্য সংস্কৃতির ছোঁয়া মাখা নাচ, গান এবং নাটকের মঞ্চস্থ হয়। শিক্ষার্থীরা ‘শিশু অধিকার’ থিমের উপর নাটক পরিবেশন করে দর্শকদের মুগ্ধ করেন, যা শিশু শোষণ এবং শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে সচেতনতা বাড়ায়। এই অংশটি অনুষ্ঠানকে উৎসবমুখর করে তোলে এবং শিশুদের সৃজনশীলতাকে উজ্লিত করে। জেলা প্রশাসক শামীম আরা রিনি অনুষ্ঠানের সমাপ্তিতে বলেন, “এই ধরনের কর্মসূচি শুধু দিবস উদযাপন নয়, বরং শিশু অধিকারের বাস্তবায়নের পথ দেখায়।”

এই অনুষ্ঠান বান্দরবানের মতো পার্বত্য জেলায় শিশু অধিকারের প্রচারে একটি মাইলফলক। দেশব্যাপী এই দিবস উদযাপনে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শাহাদতবরণকারী শিশুদের পরিবারকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে, যা শিশু সুরক্ষার প্রতি সরকারের অঙ্গীকারকে তুলে ধরে। বাংলাদেশে শিশু অধিকার সনদ-২০০০ অনুসারে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন, এবং এই অনুষ্ঠান সেই দিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।

বাংলাদেশে শিশু অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন হিসেবে কাজ করে ‘শিশু অধিকার আইন, ২০১৩’ (Children Act, 2013), যা জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ (UNCRC) ১৯৮৯-এর ভিত্তিতে প্রণীত। এই আইনটি ২০০০ সালের পূর্ববর্তী আইনগুলোকে (যেমন শিশু আইন, ১৯৭৪) প্রতিস্থাপন করে শিশুদের মৌলিক অধিকারগুলোকে আরও ব্যাপকভাবে কভার করে।

শিশুকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ১৮ বছরের কম বয়সী যেকোনো ব্যক্তি হিসেবে। এই আইনটি মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে কার্যকর এবং শিশু অধিকার সংরক্ষণে সরকার, এনজিও এবং সমাজের সম্মিলিত ভূমিকা নির্ধারণ করে।