এমপিও শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া ভাতা ৫০০ টাকা বৃদ্ধি, উৎসব বোনাস দ্বিগুণ
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়ি ভাড়া ভাতা ৫০০ টাকা বৃদ্ধি: উৎসব বোনাসও দ্বিগুণ, সরকারের বার্ষিক অতিরিক্ত খরচ ৭০০ কোটিরও বেশি
টুইট প্রতিবেদক: বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের দাবির অংশ হিসেবে বাড়ি ভাড়া ভাতা বৃদ্ধির সুখবর এসেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনমূলক সারসংক্ষেপ অনুযায়ী, প্রতি মাসে ৫০০ টাকা বাড়িয়ে এখন থেকে তারা ১,৫০০ টাকা ভাতা পাবেন।
এছাড়া, সম্প্রতি উৎসব বোনাস (উৎসব ভাতা) মূল বেতনের ২৫ শতাংশ থেকে বেড়ে ৫০ শতাংশ করা হয়েছে, যা ঈদুল আজহা থেকে কার্যকর। এই দুই সিদ্ধান্তে সরকারের বার্ষিক অতিরিক্ত খরচ প্রায় ৭০০ কোটি টাকা বাড়বে, যা শিক্ষা খাতের বাজেট চাপ বাড়ানোর সাথে সাথে শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। (সূত্র: ইত্তেফাক, দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, রাইজিং বিডি, এমটি নিউজ২৪)
বাড়ি ভাড়া ভাতা বৃদ্ধির বিস্তারিত: শতাংশের পরিবর্তে ফিক্সড ৫০০ টাকা বৃদ্ধি
বর্তমানে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা প্রতি মাসে ১,০০০ টাকা হারে বাড়ি ভাড়া ভাতা পান, যা জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫-এর অধীনে নির্ধারিত। এই ভাতা দীর্ঘদিন ধরে অপরিবর্তিত ছিল, যা বর্তমান মূল্যস্ফীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে মূল বেতনের ৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত (সর্বনিম্ন ২,০০০ টাকা) ভাতা বৃদ্ধির কথা উল্লেখ ছিল, যা বেসরকারি শিক্ষক সমিতির দাবির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এই শতাংশভিত্তিক প্রস্তাবকে অর্থনৈতিক চাপের কারণে সরিয়ে ফেলে সকলের জন্য ফিক্সড ৫০০ টাকা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, “এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বড় অংশ নিজ বাড়িতে থেকে যাতায়াত করেন, তাই শতাংশভিত্তিক বৃদ্ধি অতিরিক্ত খরচের কারণ হতো। তবু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব বিবেচনায় নিয়ে ৫০০ টাকা বাড়ানোর সারসংক্ষেপ অনুমোদন করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।”
এই বৃদ্ধি চলতি অর্থবছর (২০২৫-২৬) থেকে কার্যকর হবে। সারাদেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা ৩,৯৮,০৬৮ জন, যাদের মধ্যে স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারী ২,৯৫,০০০ এবং কলেজের ১,০৩,০০০। বর্তমানে ১,০০০ টাকা ভাতায় বার্ষিক ৪৭০ কোটি টাকা ব্যয় হয় (স্কুলে ৩৫৭ কোটি, কলেজে ১১২ কোটি)। বৃদ্ধির পর এটি বাড়বে ২৩৮ কোটি টাকা, যাতে মাসিক ১,৫০০ টাকা হিসেবে বার্ষিক মোট ৭০৮ কোটি টাকা লাগবে।
উৎসব বোনাস দ্বিগুণ: ২৫% থেকে ৫০% – ঈদুল আজহা থেকে কার্যকর
এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের উৎসব বোনাসও সম্প্রতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৪ সালের নির্দেশনা অনুসারে তারা মূল বেতনের ২৫% বোনাস পেতেন, যা দীর্ঘদিনের দাবির পর ২০২৫ সালের মে মাসে (২৬ মে) চারটি শর্তসাপেক্ষে বেড়ে ৫০% হয়েছে। এই শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে: (১) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিততা, (২) অডিট রিপোর্ট জমা, (৩) শিক্ষকদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ, এবং (৪) সরকারি নির্দেশনা পালন।
এই বৃদ্ধি প্রথমে ঈদুল আজহা (জুন ২০২৫) থেকে কার্যকর হয়েছে, এবং পরবর্তী উৎসবে (ঈদুল ফিতর, দুর্গাপূজা) প্রযোজ্য। এতে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয় বছরে ২২৯ কোটি টাকা। শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেন, “এটি শিক্ষকদের কল্যাণ নিশ্চিত করার সরকারি দায়িত্বের অংশ। দাবি আদায়ের পথে আরও উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।”
আন্দোলন থেকে সরকারি উদ্যোগ
এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা এবং উৎসব বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন। বেসরকারি শিক্ষক সমিতি ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে কর্মবিরতির হুমকি দিয়েছিল, যা ১০ অক্টোবরের মধ্যে বাস্তবায়নের দাবিতে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ১ অক্টোবর প্রস্তাব চূড়ান্ত করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়, এবং ৫ অক্টোবর অনুমোদন হয়। এর পাশাপাশি, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ বাড়ি ভাড়া-চিকিৎসা-উৎসব ভাতা বৃদ্ধির জন্য ৭৬৯ কোটি টাকা বরাদ্দের চিঠি পাঠানো হয়।
অর্থনৈতিক চাপ ও উপদেষ্টার মন্তব্য: ‘টেনশনের’ ব্যাপার
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এই বৃদ্ধিকে ‘টেনশনের’ ব্যাপার বলে অভিহিত করেছেন। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “নতুন পে-স্কেল বাস্তবায়ন (মার্চ-এপ্রিল ২০২৬ থেকে) এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি আমার সবচেয়ে ভয়ের কারণ। চলতি বাজেটে (২০২৫-২৬) জুন পর্যন্ত বাড়তি টাকা সংস্থান করতে হবে। এছাড়া, সরকার বিপুল সংখ্যক প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করেছে, যা অতিরিক্ত অর্থের চাপ তৈরি করছে।”
ড. সালেহউদ্দিন আরও যোগ করেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেই নতুন পে-স্কেল গেজেট করা হবে, পরবর্তী সরকারের অপেক্ষা করা হবে না। কিন্তু বাজেট সংশোধন (ডিসেম্বর ২০২৫) এ প্রয়োজনীয় তহবিল রাখতে হবে।” এই চাপ সত্ত্বেও, শিক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধির পরিকল্পনা চলছে, যাতে মোট খরচ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে ৭ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছায়।
শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়ন
এই বৃদ্ধি প্রায় ৪ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর মাসিক আয় ৫০০ টাকা বাড়াবে, যা বার্ষিক ৬,০০০ টাকা অতিরিক্ত। উৎসব বোনাসে দ্বিগুণিত হয়ে প্রতি উৎসবে (দুটি বছরে) মূল বেতনের সমান টাকা পাবেন। বেসরকারি শিক্ষক সমিতির সভাপতি মোরশেদ আলী বলেন, “এটি আমাদের দাবির আংশিক সাফল্য, কিন্তু চিকিৎসা ভাতা (বর্তমানে ১,৫০০ টাকা) এবং বিশেষ সুবিধা (১০% বৃদ্ধি, জুলাই ২০২৫ থেকে) আরও বাড়ানো দরকার।”
শিক্ষা উপদেষ্টা ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার ৫ অক্টোবর জানান, “এনটিআরসি (ন্যাশনাল টেকনিক্যাল রিক্রুটমেন্ট সার্ভিস)-এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান প্রধান নিয়োগ এবং আরও আর্থিক প্রণোদনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।” এছাড়া, জাতীয় বেতন কমিশন-২০২৫ (সভাপতি জাকির আহমেদ খান) ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সাধারণ নাগরিকের মতামত নিয়ে নতুন পে-স্কেল সুপারিশ করবে, যাতে বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ও শিক্ষা ভাতা বৃদ্ধির প্রস্তাব থাকবে।
এই বৃদ্ধি এমপিও শিক্ষকদের মনোবল বাড়াবে এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে সহায়ক হবে। তবে অর্থ উপদেষ্টার ‘টেনশন’ সত্ত্বেও, অন্তর্বর্তী সরকার শিক্ষা খাতে বাজেট বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ভবিষ্যতে নতুন পে-স্কেল (২০২৬ থেকে) এবং চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি (প্রস্তাবিত ১,৫০০ থেকে বাড়ানো) নিয়ে আরও সুখবর আসতে পারে। শিক্ষক সমিতি বলছে, “আংশিক সাফল্য, কিন্তু লড়াই চলবে।”